বাংলায় সেন বংশের শাসন
Contents
বাংলায় সেন বংশের শাসন

বাংলার ইতিহাসে সেন বংশের প্রতিষ্ঠা নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ । সেন বংশীয় রাজারা বাংলার রাজনীতি ও সমাজসংস্কারের কাজে বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন । পাল বংশের অবনতি ও পতনের সুযােগে সেন বংশ একাদশ শতকে বাংলায় একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সূচনা করেন । অল্পকালের মধ্যে সেন রাজ্য একটি বৃহত্তর রাজ্যে পরিণত হয় ।
সেনদের আদি বাসস্থান ছিল কর্ণাট অঞ্চল ( বর্তমান মহীশূর ) ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল । রাজশাহীর নিকটস্থ ‘ দেওপাড়া লেখ ’ থেকে জানা যায় যে , সেনরা জাতিতে ব্ৰহ্ম – ক্ষত্রিয় ছিলেন । ড. ভাণ্ডারকরের মতে , সেনরা প্রথমে ব্রাহ্মণ ছিলেন এবং পরে তাঁরা ক্ষত্রিয় ধর্ম গ্রহণ করেন ।
বাংলায় সেনদের রাজনৈতিক ইতিহাস শুরু হয় সামন্ত সেনের আমল থেকে । তিনি বৃদ্ধ বয়সে রাঢ় অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন । তবে তিনি কোনাে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেননি কিংবা রাজকীয় অভিধা নেননি । সামন্ত সেনের পুত্র হেমন্ত সেন পাল রাজাদের বিরুদ্ধে কৈবর্ত বিদ্রোহের সুযােগে রাঢ় অঞ্চলে একটি ক্ষুদ্র রাজ্য স্থাপন করেন ।
বিজয় সেন ( ১০৯৫-১১৫৮ খ্রি. )
হেমন্ত সেনের পুত্র বিজয় সেন বাংলায় শক্তিশালী সেন শাসন প্রবর্তন করেন । তিনি শূরবংশীয় রাজকন্যা বিলাসদেবীকে বিবাহ করে নিজের হাত শক্ত করেন । তিনি মদনপালকে পরাজিত করে উত্তরবঙ্গ এবং বর্মনরাজকে পরাজিত করে পূর্ববঙ্গ দখল করেন । কলিঙ্গ এবং আসামের কিছু অংশও তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল । তাঁর সভাসদ ছিলেন কবি উমাপতিধর । উমাপতিধরের ‘ দেওপাড়া প্রশস্তি ’ থেকে বিজয় সেনের কৃতিত্বপূর্ণ শাসনের কথা জানা যায় ।
বাংলার ইতিহাসে বিজয় সেনের রাজত্বকাল গৌরবময় । সামান্য একজন সামন্ত থেকে তিনি নিজস্ব যােগ্যতায় সমগ্র বাংলায় এক সুদৃঢ় ও সার্বভৌম রাজশক্তি স্থাপন করতে সমর্থ হন । পাল বংশের শাসনের পর বাংলার রাষ্ট্রীয় ঐক্য বিনষ্ট হয় এবং বাংলাদেশ খণ্ড খণ্ড রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে । বিজয় সেন সেই রাজ্যগুলি দখল করে পুনরায় এক অখণ্ড রাজশক্তি স্থাপন করেন ।
বল্লাল সেন ( ১১৫৮-১১৭৯ খ্রি. )
বিজয় সেনের পর সিংহাসনে বসেন তাঁর পুত্র বল্লাল সেন । সম্ভবত পূর্ব – বিহারের একাংশ এবং বর্তমান ২৪ পরগনা ও মেদিনীপুর জেলার একাংশ তিনি সেন সাম্রাজ্যভুক্ত করেছিলেন । বল্লাল সেনের রাজ্যসীমা পশ্চিমে মগধ ও মিথিলা থেকে পূর্বে বঙ্গ পর্যন্ত এবং উত্তরে দিনাজপুর , রংপুর ও বগুড়া থেকে দক্ষিণে সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল । বল্লাল সেনের সুবিস্তৃত রাজ্য রাঢ় , বরেন্দ্রী , বঙ্গ , বাগড়ী ও মিথিলা — এই পাঁচটি অংশে বিভক্ত ছিল । প্রতিটি অংশ এক – একজন শাসনকর্তার শাসনাধীন ছিল । বল্লান সেন বিদ্বান ও খ্যাতিমান লেখক ছিলেন । তিনি ‘ দানসাগর ’ ও ‘ অদ্ভুতসাগর ’ নামক দুটি গ্রন্থ লেখেন । তাঁর উদ্যোগেই বাংলাদেশে কৌলীন্য প্রথার প্রচলন হয় । তাঁর এই রক্ষণশীল মনােভাবের কারণে জাতিভেদের কঠোরতা বৃদ্ধি পেয়েছিল ।
লক্ষ্মণ সেন ( ১১৭৯-১২০৭ খ্রি. )
সেন বংশের শেষ উল্লেখযােগ্য রাজা ছিলেন বল্লাল সেনের পুত্র লক্ষ্মণ সেন । সুযােদ্ধা হিসেবে তিনি সেন রাজাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন । তাঁর রাজত্বকালের কয়েকটি তাম্রশাসন , সভা কবিদের রচিত প্রশস্তি ও মুসলমান ঐতিহাসিক মিনাজউদ্দিনের লেখা ‘ তবকৎ ই নাসিরী ’ ইত্যাদি গ্রন্থ থেকে লক্ষ্মণ সেনের রাজত্বকালের সংক্ষিপ্ত পরিচয় পাওয়া যায় । তিনিও পিতার ন্যায় সুলেখক ছিলেন । পিতার অসমাপ্ত ‘ অদ্ভুতসাগর ’ গ্রন্থটি তিনিই সম্পূর্ণ করেন ।
লক্ষ্মণ সেনের আমলে বাংলার পশ্চিমে গাড়ােয়াল রাজাদের দ্রুত ক্ষমতা বিস্তার ঘটছিল । লক্ষ্মণ সেন গাড়ােয়াল রাজ্য আক্রমণ করে তাদের ক্ষমতা নাশ করেন । শিলালিপি থেকে জানা যায় যে , তিনি গৌড় , কামরূপ ও কলিঙ্গ সেনরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন । কথিত আছে , পুরী , এলাহাবাদ ও বারাণসীতে তিনি বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করেছিলেন । তাঁর নামানুসারে রাজধানী গৌড়ের নাম হয় লক্ষ্মণাবতী । উত্তরে গৌড় , পূর্বে কামরূপ ও দক্ষিণে কলিঙ্গের রাজাকে পরাজিত করে লক্ষ্মণ সেন পৈতৃক রাজ্য অক্ষুন্ন ও সুদৃঢ় করতে সমর্থ হন । পূর্বসূরিদের তুলনায় পশ্চিমে তিনি অধিক সাফল্য অর্জন করেন এবং মগধ পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার করতে সক্ষম হন । তিনি গৌড়েশ্বর , অরিরাজ-মর্দন-শঙ্কর , পরম বৈষ্ণব প্রভৃতি উপাধি গ্রহণ করেছিলেন ।