সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে মগধের উত্থান
Contents
সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে মগধের উত্থান
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্রে মােট ১৬ টি জনপদের উল্লেখ পাওয়া যায় । এদের মধ্যে কোশল , অবন্তি , বৎস ও মগধ ছিল অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী রাজ্য । এদের মধ্যে শেষ পর্যন্ত মগধ বাকি রাজ্যগুলিকে পরাজিত করে এক সুবৃহৎ সাম্রাজ্য গঠনে সক্ষম হয়েছিল ।

হর্ষঙ্ক বংশ
বিম্বিসার :
বৌদ্ধচরিত থেকে জানা যায় হর্ষঙ্ক বংশের বিম্বিসারের রাজত্বকালেই মগধের সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু হয়েছিল । তিনি সম্ভবত ৫৪৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মগধের সিংহাসনে বসেন । তিনি ছিলেন উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন শাসক । রাজ্যবিস্তারে বিম্বিসার দু – প্রকার নীতি অনুসরণ করতেন — বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন ও যুদ্ধ । বিম্বিসার কোশল রাজকন্যা কোশলদেবীকে বিবাহ করে কাশী লাভ করেন । বৈশালী রাজকন্যা চেল্লনাকে বিবাহ করার ফলে মগধের ক্ষমতা ও মর্যাদা বৃদ্ধি পায় । এ ছাড়া , বিদেহ রাজকন্যা বাসবী ও মদ্র রাজকন্যা ক্ষেমাকে বিবাহ করে নিজেকে আরও শক্তিশালী করেন । অতঃপর তিনি অঙ্গরাজ্য আক্রমণ করেন এবং অঙ্গরাজ ব্ৰহ্মদত্তকে পরাজিত ও নিহত করে অঙ্গরাজ্যকে মগধ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন । ড. এইচ. রায়চৌধুরীর মতে , “ বিম্বিসারের অঙ্গজয়ের দ্বারা মগধ সাম্রাজ্যবাদের যে সূচনা হয় , অশােকের কলিঙ্গজয়ে তার সমাপ্তি ঘটে ”। অবন্তিরাজ প্রদ্যোতের সঙ্গেও তাঁর বন্ধুত্ব ছিল ।
কেবলমাত্র বিজেতা নয় , শাসকরূপেও বিম্বিসার ছিলেন অত্যন্ত সফল । উপযুক্ত কর্মচারী নিয়ােগ , স্বায়ত্তশাসনব্যবস্থার প্রবর্তন , জমি জরিপ করে কর – নির্ধারণ প্রভৃতি তাঁর যােগ্যতার প্রমাণ রাখে । বিম্বিসার বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ছিলেন , তবে অন্যান্য ধর্মের প্রতিও তাঁর শ্রদ্ধা ছিল । আনুমানিক ৪৯২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি নিজ পুত্র অজাতশত্রুর হাতে নিহত হন ।
অজাতশত্রু :
অজাতশত্রু ( খ্রি. পূ. ৪৯৩-৪৬২ অব্দ ) পিতার রাজ্যবিস্তারনীতি অক্ষুন্ন রাখেন । বিম্বিসারের হত্যাকাণ্ডে মর্মাহত কোশলদেবী প্রাণত্যাগ করলে তাঁর ভাই কোশলরাজ প্রসেনজিৎ কাশী পুনর্দখল করেন । ফলে অজাতশত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ বাধে । দীর্ঘদিন যুদ্ধ চলার পর প্রসেনজিৎ পরাস্ত হন এবং নিজ কন্যার সঙ্গে অজাতশত্রুর বিয়ে দিয়ে এবং কাশী ( বেনারস ) যৌতুক হিসেবে প্রদান করে মিত্রতা স্থাপন করেন । অতঃপর অজাতশত্রু বৈশালীর লিচ্ছবীরাজ চেতকের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন । অধ্যাপক ব্যাসামের মতে , গঙ্গার উপকূল অঞ্চল অধিকারে রাখাই ছিল যুদ্ধের কারণ । এই যুদ্ধে বৃজি , মল্লসহ প্রায় ৩৬ টি গণরাজ্য অজাতশত্রুর বিরুদ্ধে ও বৈশালীর পক্ষে যুদ্ধে যােগ দিয়েছিল । কিন্তু অজাতশত্রু কূটকৌশলে গণরাজ্যগুলির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেন । প্রায় ১৬ বছর যুদ্ধের পর গণরাজ্যগুলির পতন ঘটে । এই যুদ্ধে অজাতশত্রু মহাশিলীকণ্টক ও রথমূশল নামক দুটি নতুন অস্ত্র ব্যবহার করেছিলেন । প্রথমটি ছিল পাথর ছােড়ার যন্ত্র এবং দ্বিতীয়টি ছিল তিরের মতাে ফলাযুক্ত একটি দুর্ভেদ্য রথ । এই সময় মগধরাজ গঙ্গা ও শােন নদীর সংগমস্থলে পাটলিগ্রামে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন পরবর্তীকালে সেখানেই পাটলিপুত্র নগর গড়ে উঠেছিল ।
পরবর্তী শাসকগণ :
অজাতশত্রুর পরে মগধের সিংহাসনে বসেন উদয়িন । তাঁর উদ্যোগেই বিশ্বখ্যাত পাটলিপুত্র মহানগরী নির্মিত হয়েছিল । উদয়িনের পরে যথাক্রমে অনিরুদ্ধ , মুণ্ড ও নাগদাসক মগধের সিংহাসনে বসেন । তাঁরা সমষ্টিগতভাবে খ্রিস্টপূর্ব ৪৬২-৪৩০ অব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন । এঁরা সবাই ছিলেন পিতৃহন্তা ও অযােগ্য শাসক । ফলে সাধারণ মানুষ এদের প্রতি ক্ষুদ্ধ ছিল । সেই সুযােগে জনৈক অমাত্য শিশুনাগ নাগদাসককে হত্যা করে মগধের সিংহাসন দখল করেন ।
শিশুনাগ বংশ
শিশুনাগ সিংহাসনে বসেই অবন্তির সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন , এবং জয়লাভ করে অবন্তিকে মগধ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন । তিনি মগধের রাজধানী রাজগৃহ থেকে বৈশালীতে স্থানান্তরিত করেন । পরবর্তী রাজা কাকবর্ণ বা কালাশােক আবার পাটলিপুত্রে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে যান । এর উদ্যোগেই বৈশালীতে দ্বিতীয় বৌদ্ধসংগীতি আহূত হয়েছিল । অবশেষে জনৈক শূদ্র কালাশােক ও তাঁর পুত্রদের হত্যা করে মগধের সিংহাসন দখল করে নেন । এই শূদ্রই ছিলেন মগধে নন্দবংশের প্রতিষ্ঠাতা ( ৩৬৪ খ্রি. পূ. ) মহাপদ্মনন্দ ।
নন্দবংশ
মহাপদ্মনন্দ :
নন্দবংশের শাসন চলে খ্রিস্টপূর্ব ৩২৪ অব্দ পর্যন্ত । পুরাণ ও গ্রিক রচনা থেকে মহাপদ্মনন্দ সম্পর্কে তথ্যাদি জানা যায় । তাঁকে সর্বক্ষত্রিয়ােচ্ছেত্তা ও দ্বিতীয় পরশুরাম বলে বর্ণনা করা হয়েছে । এ কথা প্রমাণ করে তিনি বহু ক্ষত্রিয় রাজবংশের উচ্ছেদ ঘটিয়েছিলেন । তাঁর সময়ে কোশল রাজ্য মগধ সাম্রাজ্যভুক্ত হয় । এ ছাড়া তিনি যেসব ক্ষত্রিয়রাজ্য দখল করেছিলেন , সেগুলি হল — পাল , কাশী , ইক্ষাকু , কলিঙ্গ , অস্মক , কুরু , মিথিলা প্রভৃতি । মহাপদ্মনন্দ ছিলেন উত্তর ভারতের প্রথম সম্রাট । রাধাকুমুদ মুখােপাধ্যায় – এর ভাষায় “ Mahapadma is the first great historical emperor of Northern India ” তাঁর আমলেই মগধ প্রকৃত অর্থে একটি সাম্রাজ্যের চরিত্র লাভ করেছিল । শুধু বিজেতা নয় , শাসক হিসেবেও তিনি ছিলেন সুদক্ষ ।
ধননন্দ :
মহাপদ্মনন্দের পর আরও আটজন নন্দবংশীয় রাজা মগধের সিংহাসনে বসেন । এঁরা একত্রে নবনন্দ নামে পরিচিত । এঁদের সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না । এই বংশের শেষ রাজা ছিলেন ধননন্দ । অর্থের প্রতি অত্যধিক আসক্তির জন্য তাঁর এইরুপ নামকরণ হয়েছিল বলে কথিত আছে । গ্রিক লেখকদের রচনা থেকে ধননন্দের অতুল শক্তি ও বিশাল সেনাবাহিনীর কথা জানা যায় । গ্রিকবীর আলেকজান্ডার সেই সময় ভারত আক্রমণ করলেও ধননন্দের রাজ্য আক্রমণ করতে সাহস করেননি । বিশাল বাহিনীর ব্যয়নির্বাহের জন্য ধননন্দ প্রজাদের ওপর করের বােঝা ভীষণভাবে বাড়িয়ে দেন । কর আদায়ের জন্য কর্মচারীদের অত্যাচারও কম ছিল না । ফলে তাঁর বিরুদ্ধে জন – অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছিল । শূদ্র হওয়ার জন্য প্রতাপশালী ব্রাহ্মণদের ক্ষোভ তাে ছিলই ; এই অবস্থায় কৌটিল্য ( চাণক্য ) নামক জনৈক প্রতিশােধকামী ব্রাহ্মণের সহায়তায় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য নামক এক ক্ষত্রিয় যুবক নন্দবংশের উচ্ছেদসাধন করে মগধের সিংহাসন দখল করেন । অতঃপর মৌর্যবংশের নেতৃত্বে মগধের সাম্রাজ্যবাদ এগিয়ে চলে ।