ইতিহাস

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের অবদান

Contents

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের অবদান

index 17
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য

রাজ‍্য বিজেতা রূপে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের অবদান

ভারতে মৌর্য শাসনের প্রতিষ্ঠা করেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ( খ্রিঃ পূঃ ৩২৪-৩০০ অব্দ ) । নন্দবংশের শাসনের উচ্ছেদ করে তিনি মৌর্য শাসনের সূচনা করেন । এই কাজে চন্দ্রগুপ্তের প্রধান পরামর্শদাতা ছিলেন পণ্ডিত চাণক্য বা কৌটিল্য

নন্দ বংশের উচ্ছেদ :

সেনাদল গঠন করে চন্দ্রগুপ্ত রাজ্যজয়ে মন দেন । তবে প্রথমে তিনি নন্দবংশের উচ্ছেদ করেছিলেন , নাকি প্রথমে গ্রিকদের বিতাড়িত করেছিলেন —তা নিয়ে মতভেদ আছে । যাই হােক , নন্দবংশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে চন্দ্রগুপ্ত ব্যাপক জনসমর্থন লাভ করেছিলেন । কারণ নন্দরাজাদের আর্থিক ও রাজনৈতিক অত্যাচারে জনগণ প্রচণ্ড বিক্ষুদ্ধ ছিল । ‘ মিলিন্দপঞ্হ ’ থেকে জানা যায় , চন্দ্রগুপ্ত প্রথম দুটি অভিযানে নন্দরাজাদের কাছে পরাজিত হন এবং তৃতীয় অভিযানে সাফল্য লাভ করেন । খ্রিস্টপূর্ব ৩২৪ অব্দে ধননন্দকে পরাজিত করে চন্দ্রগুপ্ত মগধের সিংহাসন দখল করেন ।

গ্রিক বিতাড়ন :

চন্দ্রগুপ্তের আর  একটি কীর্তি হল উত্তর – পশ্চিম ভারত থেকে গ্রিক – শাসনের অবসান ঘটানাে । আলেকজান্ডারের মৃত্যুর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ভারতের গ্রিক রাজ্যগুলির মধ্যে আত্মকলহ শুরু হয় । সেই সঙ্গে গ্রিকশাসনের বিরুদ্ধে গণবিদ্রোহও শুরু হয়েছিল । এই সুযােগে চন্দ্রগুপ্ত এক – একটি গ্রিক রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান চালান ও গ্রিকদের বিতাড়িত করে তা নিজের সাম্রাজ্যভুক্ত করেন । এইভাবে সিন্ধু ও পূর্ব পাঞ্জাব মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের পশ্চিম ভারত জয় :

অতঃপর চন্দ্রগুপ্ত পশ্চিম ভারতের মালব , সৌরাষ্ট্র , গুজরাট প্রভৃতি রাজ্য দখল করেন । প্লুটার্কের  মতে , এই অভিযানের সময় চন্দ্রগুপ্তের সৈন্যসংখ্যা ছয় লক্ষে পৌঁছেছিল ।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের দক্ষিণ ভারত জয় :

দক্ষিণ ভারতে চন্দ্রগুপ্তের রাজ্যসীমা কতদূর বিস্তৃত ছিল সে – সম্পর্কে মতভেদ আছে । ঐতিহাসিক স্মিথ – এর মতে , বিন্দুসারের আমলে দক্ষিণ ভারতে মৌর্যসাম্রাজ্য বিস্তৃত হয়েছিল । কিন্তু এইচ. সি. রায়চৌধুরি  প্রমুখ এই মত অস্বীকার করেন । হরিষেণ বিরচিত বৃহৎ কথাকোষ , রত্নানন্দের ভদ্রবাহু  চরিত বা জৈনগ্রন্থাদিতেও চন্দ্রগুপ্তের দক্ষিণ ভারত জয়ের উল্লেখ পাওয়া যায় । সম্ভবত নন্দবংশকে পরাজিত করার সূত্রে চন্দ্রগুপ্ত দক্ষিণ ভারতের রাজ্যাংশ লাভ করেছিলেন এবং পরে আরও কিছু রাজ্য দখল করেছিলেন । তামিলনাড়ু ও মহীশূরে অশােকের শিলালিপি পাওয়া গেছে । যেহেতু বিন্দুসার বা অশােক কেউই ওইসব অঞ্চলে অভিযান পাঠাননি , তাই ওইসব স্থান চন্দ্রগুপ্ত জয় করেছিলেন ধরা যেতে পারে । বাংলা দেশেও চন্দ্রগুপ্তের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ।

সেলুকাসের সঙ্গে যুদ্ধ :

রাজত্বের শেষদিকে আলেকজান্ডারের সেনাপতি তথা ব্যাবিলনের শাসক সেলুকাসের সঙ্গে চন্দ্রগুপ্তের সংঘর্ষ হয় । আলেকজান্ডারের হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধারের আশায় সেলুকাস ভারত আক্রমণ করেন । তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৩০৫ অব্দে সিন্ধু – অঞ্চলে উপস্থিত হলে চন্দ্রগুপ্ত তাঁকে বাধা দেন । এই যুদ্ধ আদৌ হয়েছিল কি না বা হলে তার পরিণতি কী হয়েছিল — সে বিবরণ পাওয়া যায় না । কেবল স্ট্যাবো-র রচনা থেকে উভয়ের মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি সন্ধির কথা জানা যায় । সন্ধির শর্তানুযায়ী সেলুকাস চন্দ্রগুপ্তকে কাবুল , কান্দাহার , হীরাট ও বালুচিস্তান প্রদান করেন এবং নিজ কন্যার সঙ্গে চন্দ্রগুপ্তের বিবাহ দেন । পরিবর্তে তিনি চন্দ্রগুপ্তের থেকে পাঁচশাে হাতি পান । গ্রিকদূত মেগাস্থিনিসকে চন্দ্রগুপ্তের দরবারে পাঠানাে হয় । এই সন্ধি বিশ্লেষণ করে অনেকে মনে করেন , এই যুদ্ধে সেলুকাস পরাজিত হয়েছিলেন । এই সন্ধির গুরুত্ব প্রসঙ্গে ড. স্মিথ  বলেন যে , দু – হাজার বছর পূর্বে চন্দ্রগুপ্ত যে বৈজ্ঞানিক সীমান্ত ( Scientific Border ) – এর অধিকারী হয়েছিলেন , তা মােগলগণ বা ইংরেজগণ পাওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিলেন ।

শাসক রূপে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের অবদান

কেবল রাজ্যজয় নয় , সুশাসন প্রবর্তনের ক্ষেত্রেও চন্দ্রগুপ্ত যথেষ্ট দক্ষতা দেখিয়েছেন । এক বৃহৎ সাম্রাজ্যে সুনিয়ন্ত্রিত অথচ বিকেন্দ্রীকৃত শাসনকাঠামাের প্রতিষ্ঠা চন্দ্রগুপ্তের এক অনন্য কীর্তি । সমগ্র শাসনব্যবস্থার কেন্দ্রে ছিলেন সম্রাট স্বয়ং । তিনি ছিলেন সমস্ত ক্ষমতার উৎস । কিন্তু স্বৈরাচারী ক্ষমতার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি মন্ত্রীপরিষদ ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনব্যবস্থাকে যে মর্যাদা দিয়েছিলেন তা প্রশংসার যােগ্য । কৌটিল্য চন্দ্রগুপ্তের শাসনব্যবস্থায় প্রজাহিতৈষনার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন । বিচারে ন্যায়পরায়ণতা ও ধর্মানুশীলনে সহিষ্ণুতা ছিল তাঁর চরিত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ।

উচ্চপদস্থ কর্মচারী :

সুষ্ঠু শাসন পরিচালনার জন্য রাজা কর্মচারী নিয়ােগ করতেন । মন্ত্রিণ , অমাত্য , অধ্যক্ষ ইত্যাদি উচ্চ কর্মচারীর সাহায্যে তিনি শাসন পরিচালনা করতেন ।

প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা :

সমগ্র সাম্রাজ্যকে চারটি প্রদেশে ভাগ করা হয়েছিল— ( i ) প্রাচ্য , ( ii ) উত্তরাপথ , ( iii ) দক্ষিণাপথ এবং ( iv ) অবন্তি । প্রতিটি প্রদেশের দায়িত্বে থাকতেন একজন করে ‘ কুমারমাত্য ’ । সাধারণত রাজপরিবারের ঘনিষ্ট কাউকে এই পদে নিযুক্ত করা হত ।

সামরিক বিভাগ :

চন্দ্রগুপ্তের বিশাল সেনাবাহিনী ছিল । মেগাস্থিনিসের মতে সামরিক বিভাগে পাঁচসদস্য বিশিষ্ট ছয়টি সমিতি ছিল । সমিতিগুলি পদাতিক , অশ্বারােহী , রথ , হস্তি , নৌবহর , যােগাযােগ ও সরবরাহ বিভাগ পরিচালনা করত ।

পৌর শাসন :

মেগাস্থিনিসের বিবরণ থেকে জানা যায় , পাটলিপুত্রের শাসনভার ছিল ৩০ জন সদস্যের একটি নগরপরিষদের ওপর । কারিগরি শিল্পক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ , জন্মমৃত্যুর হিসাব রাখা , বিদেশি আগন্তুকদের তত্ত্বাবধান , বিক্রিত পণ্যের ওপর শুল্ক আদায় ইত্যাদি বিভিন্ন কাজের দায়িত্ব ছিল এদের ওপর ।

গুপ্তচর ব্যবস্থা :

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আমলে এক সুদক্ষ গুপ্তচর ব্যবস্থার মাধ্যমে সম্রাট তাঁর সাম্রাজ্যের সমস্ত ঘটনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকতেন । শিল্প ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপােষক হিসেবেও চন্দ্রগুপ্ত স্মরণীয় । মেগাস্থিনিসের বিবরণ থেকে তাঁর অনন্য শিল্পবােধের পরিচয় পাওয়া যায় । তাঁর আমলে পাটলিপুত্রের সৌন্দর্য বিদেশিদের ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছে ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!