ভারতের ইতিহাসে কুষাণ যুগের অবদান
Contents
ভারতের ইতিহাসে কুষাণ যুগের অবদান

কুষাণ যুগের রাজনৈতিক ঐক্য
ভারতের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে কুষাণ যুগের অবদান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ । মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা ছিল বিশৃঙ্খল । কুষাণরা সেখানে রাজনৈতিক শৃঙ্খলা প্রবর্তন করেন । স্থাপিত হয় অভ্যন্তরীণ শান্তি । এই শান্তি ও নিরাপত্তা দেশের সমৃদ্ধি ফিরিয়ে আনে । এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নবজীবনের সূচনা করে । ড. দীনেশচন্দ্র সরকারের মতে , কুষাণ যুগ ভারত – ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ( The Kushana period marks an important epoch in Indian History ) । সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিদেশি কুষাণ জাতির অবদান অবিস্মরণীয় । বি. জি. গােখেল বলেছেন — সাংস্কৃতিক দিক থেকে কুষাণ যুগ ভারত – ইতিহাসে তাৎপর্যপূর্ণ ( The age of the great Kushanas is of great cultural significance in the history of India ) । কুষাণ রাজাদের সাংস্কৃতিক অবদান স্মরণ করে ঐতিহাসিক রলিনসন লিখেছেন যে , শিক্ষা , ধর্ম , সমাজ , শিল্পকলা , সাহিত্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে কুষাণ যুগে অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটেছিল ।
কুষাণ যুগের সমন্বয় বাদ
( i ) কুষাণ যুগের সংস্কৃতির মূল বৈশিষ্ট্য ছিল সাঙ্গীকরণ । বিভিন্ন ধরনের মানুষকে তাঁরা একই সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন । সাঙ্গীকরণ ঘটে উপজাতিদের মধ্যেও । ফলে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশের মধ্যে সমন্বয় সাধিত হয় ।
( ii ) সমন্বয়ের ধারা দেশের সীমা অতিক্রম করে রােম , দক্ষিণ – পূর্ব এশিয়া এবং দূর প্রাচ্যেও প্রসারিত হয় । কুষাণ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে ভারতীয় সভ্যতার মিলন ঘটে ।
( iii ) কুষাণরা কেবল গ্রহণ করেনি , দানও করেছিল । ভারতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে কুষাণদের সংস্কৃতির মেলবন্ধন এক উদার ও সমন্বয়ী সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছিল । তাই কুষাণ সাম্রাজ্যের অবসানের পরেও সেই সংস্কৃতির ধারা অব্যাহত ছিল ।
আরো পড়ুন : কুষাণ কাদের বলা হয়
গুপ্ত যুগকে সুবর্ণ যুগ বলা হয় কেন
কুষাণ যুগে ব্যবসা বাণিজ্যের বিকাশ
( i ) কুষাণ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ভারতীয় অর্থনীতিকে প্রাণবন্ত করেছিল । পশ্চিম ও মধ্য এশিয়া এবং উত্তর পশ্চিম ভারত কুষাণদের অধীনে থাকায় ব্যাবসাবাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল । তখন চিন ও রােম সাম্রাজ্যের মধ্যে ‘ রেশম পথ ’ দিয়ে বাণিজ্য চলত । এই ‘ রেশম পথ ’ ( Silk Route ) মধ্য এশিয়া ও আফগানিস্তানের ওপর দিয়ে প্রসারিত ছিল । এই পথ কুষাণদের করায়ত্ত থাকার ফলে তারা প্রচুর পরিমাণে বাণিজ্য শুল্ক পেত । এই আর্থিক সমৃদ্ধি ভারতীয় অর্থব্যবস্থাকে সচ্ছল করেছিল ।
( ii ) কুষাণ রাজারাই ভারতে সর্বপ্রথম স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন করেছিলেন । রপ্তানিবাণিজ্যের মাধ্যমে রােমান সাম্রাজ্য থেকে ভারতে প্রচুর সােনা আমদানি সম্ভব হয়েছিল । কুষাণ রাজাদের এহেন আর্থিক সমৃদ্ধি ভারতীয় অর্থনীতি ও শিল্প – স্থাপত্যকে গতিশীল করেছিল ।
কুষাণ যুগের সাহিত্য
( i ) সাহিত্য ও শিল্পের ক্ষেত্রে কুষাণ যুগের অবদান গুরুত্বপূর্ণ । কনিষ্ক ছিলেন সাহিত্যের একান্ত অনুরাগী । তাঁর রাজসভা অলংকৃত করেছিলেন অশ্বঘােষ , নাগার্জুন , বসুমিত্র , চরক প্রমুখ জ্ঞানীগুণী পণ্ডিতেরা ।
( ii ) কুষাণ রাজাদের উদ্যোগে সংস্কৃত সাহিত্য বিকাশলাভ করে । অশ্বঘােষ সংস্কৃত ভাষায় রচনা করেন ‘ বুদ্ধচরিত ’ । এতে বুদ্ধের জীবনী চিত্রিত হয়েছে । তাঁর অন্য দুটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হল ‘ বজ্ৰসূচী ’ ও ‘ সৌন্দরানন্দ ’ । বৌদ্ধগ্রন্থ ‘ মহাবস্তু ’ , ‘ দিব্যবদান ’ প্রভৃতিও সংস্কৃত ভাষায় রচিত হয় । বৌদ্ধশাস্ত্রকার নাগার্জুন রচনা করেন ‘ মাধ্যমিকা সূত্র ’ ও ‘ শতসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা ’। বসুমিত্রের ‘ মহাবিভাষা ’ সে – যুগের একটি অমর সৃষ্টি । আয়ুর্বেদ চিকিৎসাবিষয়ক প্রখ্যাত গ্রন্থ , ‘ চরক–সংহিতা ’ রচনা করেন আয়ুর্বেদাচার্য চরক ।
কুষাণ যুগের ধর্ম সহিষ্ণুতা
( i ) কুষাণ যুগ ছিল ধর্মসহিষ্ণুতা ও ধর্মীয় পুনরুত্থানের কাল । কুষাণ রাজারা ছিলেন মূলত বৌদ্ধধর্মের অনুরাগী । কনিষ্কের উদ্যোগে বৌদ্ধধর্মের সংস্কারসাধন ঘটে এবং ‘ মহাযান ’ ধর্মমতের বিকাশ হয় ।
( ii ) রাজাদের উদার ও সহিষ্ণু মানসিকতার জন্য কুষাণযুগে শৈব , বৈষ্ণব , কার্তিকেয় ইত্যাদি নানা ধর্মসম্প্রদায়ের উত্থান ও প্রতিষ্ঠা ঘটে । কুষাণ যুগের মুদ্রায় গ্রিক , পারসিক ও অন্যান্য হিন্দু দেবদেবীর খােদিত মূর্তি থেকে কুষাণ রাজাদের ধর্মসহিষ্ণুতার প্রমাণ মেলে ।
বহির্বিশ্বের সাথে যােগাযােগ
( i ) বহির্বিশ্বে ভারতীয় সভ্যতা – সংস্কৃতি প্রসারের কৃতিত্ব কুষাণদের প্রাপ্য । প্রথম কনিষ্ক মধ্য এশিয়ার কাশগড় , খােটান , চিন , জাপান প্রভৃতি দেশে ভারতীয় ধর্ম ও সভ্যতার বার্তা পৌঁছে দেন । মধ্য এশিয়ায় ভারতীয় উপনিবেশের অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয়েছে । এই কাজে মুখ্য ভূমিকা ছিল কুষাণ রাজাদের ।
( ii ) কুষাণ রাজাদের উদ্যোগেই মধ্য এশিয়ার উপজাতীয় মানুষ বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে ভারতীয় সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসতে পারে । কুষাণদের উদ্যোগে মধ্য ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক যােগসাধন ঘটে ।
কুষাণ যুগের শিল্প ও ভাস্কর্য
শিল্পকলার ক্ষেত্রেও কুষাণ যুগের অবদান স্মরণীয় ।
( i ) গ্রিক , রােম ও ভারতীয় শিল্পকলার সমন্বয়ে কুষাণ যুগে এক নতুন শিল্পরীতি বিকাশ লাভ করে । এই রীতি গান্ধার শিল্প নামে পরিচিত । ইতিপূর্বে বুদ্ধের মূর্তিকে ভিত্তি করে শিল্পচর্চার প্রচলন প্রায় ছিল না । কিন্তু গান্ধার শিল্পের মূল বিষয়বস্তু ছিল বুদ্ধ এবং বৌদ্ধধর্ম । এখানে প্রতীকের বদলে মূর্তি নির্মাণের বিষয়টি গুরুত্ব পায় । গ্রিক ও ভারতীয় শিল্পরীতির সংমিশ্রণে ভারতীয় বুদ্ধ যেন গ্রিক – দেবতা অ্যাপােলাের ভিন্ন রূপে আবির্ভূত হন । তবে বিদেশি ধারায় প্রভাবিত হলেও গান্ধার শিল্পে ভারতীয় ধারার প্রাধান্য বজায় ছিল । তাই বলা হয় , গান্ধারের শিল্পীদের হাত দুটি ছিল গ্রিক ও রােমক , কিন্তু হৃদয় ছিল সম্পূর্ণ ভারতীয় ।
( ii ) কুষাণ রাজাদের উৎসাহে মথুরাতে সম্পূর্ণ ভারতীয় রীতিতে ভাস্কর্যশিল্প গড়ে ওঠে । লাল রং – এর বালি ও পাথরের সংমিশ্রণে সৃষ্ট এই শিল্প ছিল অনবদ্য । মথুরা শিল্পের মূল বিষয় ছিল বুদ্ধমূর্তি । তবে জৈন মহাবীর ও ধর্মনিরপেক্ষ কিছু জিনিসও এর বিষয়বস্তু ছিল ।
সব মিলিয়ে বলা যায় যে , ভারত – ইতিহাসে কুষাণ যুগের অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে । রাজনৈতিক অনৈক্যের অবসান , শিল্প – সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশ , সমৃদ্ধ বাণিজ্য , সামাজিক সহনশীলতার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি কাজের মধ্যে দিয়ে কুষাণ রাজারা ভারত – ইতিহাসে এক নবযুগের সূচনা করেছেন । শান্তি , সমৃদ্ধি ও সাংস্কৃতিক পুনরুজ্জীবনের বিচারে কুষাণ যুগকে পণ্ডিত রলিনসন যথার্থই ‘ গুপ্ত যুগের প্রস্তাবনা ’ ( The Kushana period is a fitting prelude to the Age of the Guptas ) বলেছেন।