ইতিহাস

মৌর্য সাম্রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা

Contents

মৌর্য সাম্রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা

মৌর্য শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে জানার মূল সূত্রগুলি হল— ( i ) কৌটিল্যেরঅর্থশাস্ত্র ’ , ( ii ) মেগাস্থিনিসের ‘ ইন্ডিকা , ( iii ) অশােকের শিলালিপি ইত্যাদি । মৌর্য শাসন ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে চন্দ্রগুপ্তের সৃষ্টি এ কথা বলা যায় না । কারণ তাঁর আগেও একটা শাসন পদ্ধতি মগধে প্রচলিত ছিল । চন্দ্রগুপ্ত নিশ্চয়ই তা গ্রহণ করেছিলেন । তবে প্রয়ােজন ও পরিস্থিতি অনুযায়ী তিনি তার পরিবর্তনও করেছিলেন ।

index 13
Maurya Empire

রাজার কর্তব্য

সমগ্র শাসন ব্যবস্থার কেন্দ্রে ছিলেন সম্রাট স্বয়ং । তিনি ছিলেন সমস্ত ক্ষমতার উৎস । তার প্রধান কর্তব্য ছিল প্রজার ধন ও প্রাণ রক্ষা । দেশ রক্ষার জন্য তাকে যুদ্ধ যাত্রা করতে হত । রাজপদ ছিল বংশানুক্রমিক ।

কেন্দ্রীয় কর্মচারী শ্রেণি

সম্রাটকে রাজকার্যে সাহায্যের জন্য মন্ত্রী , অমাত্য , মন্ত্রী পরিষদ , অধ্যক্ষ ইত্যাদি উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিল । ‘ অর্থশাস্ত্র ’ থেকে সমাহর্তা সন্নিধাতা নামে দুটি বিশেষ অমাত্যের কথা এবং বত্রিশজন অধ্যক্ষের কথা জানা যায় ।

প্রাদেশিক শাসন

সুশাসনের জন্য মৌর্য সাম্রাজ্যকে উত্তরাপথ , অবন্তিপথ , দক্ষিণাপথ প্রাচ্য এই চারটি ভাগে ভাগ করা হয় । পরবর্তীকালে কলিঙ্গ প্রদেশের অন্তর্ভুক্তি ঘটে । প্রতিটি প্রদেশ কয়েকটি বিষয়ে , প্রতিটি বিষয় কয়েকটি জনপদে , প্রতিটি জনপদ কয়েকটি গ্রামে বিভক্ত ছিল । ‘ কুমারামাত্য ’ ও ‘প্রাদেশিক’রা প্রদেশের , ‘ সমাহর্তা ’ জেলার , ‘ স্থানিক ’ জনপদের , ‘ গ্রামিক ’ গ্রামের শাসন কাজ দেখাশােনা করত । পাঁচ – দশটি গ্রামের শাসনকাজ দেখতেন ‘ গােপ ’ নামক কর্মচারীরা ।

সামরিক বিভাগ

চন্দ্রগুপ্তের বিশাল সেনাবাহিনী ছিল । মেগাস্থিনিসের মতে , সামরিক বিভাগে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট ছয়টি সমিতি ছিল । সমিতিগুলি পদাতিক , অশ্বারােহী , রথ , হস্তি , নৌবহর , যােগাযােগ ও সরবরাহ বিভাগ পরিচালনা করত ।

পৌরশাসন

মেগাস্থিনিসের বিবরণ থেকে জানা যায় , পাটলিপুত্রের শাসনভার ছিল ৩০ জন সদস্যের একটি নগরপরিষদের ওপর । এই নগরপরিষদ ৫ জন সদস্য বিশিষ্ট ছয়টি সমিতিতে বিভক্ত ছিল । এক – একটি সমিতি এক – একটি বিভাগ দেখাশুনা করত । যথা— ( i ) জন্মমৃত্যু হিসাব রক্ষা , ( ii ) বিদেশি আগন্তুকদের তত্ত্বাবধান , ( iii ) ব্যাবসাবাণিজ্য পরিচালনা , ( iv ) শিল্পজাত দ্রব্যের ক্রয় – বিক্রয় , ( v ) বিক্রিত পণ্যের ওপর দশ শতাংশ শুল্ক আদায় , ( vi ) কারিগরি শিল্পের ওপর নিয়ন্ত্রণ ।

বিচার ব্যবস্থা

সম্রাট ছিলেন সর্বোচ্চ বিচারক । ‘ অর্থশাস্ত্র ’ থেকে ‘ ধর্মস্থির ’ ও ‘ কণ্টক শােধন ’ নামে দুটি উচ্চ বিচারালয় এবং ‘ স্থানীয় ’ , ‘ দ্রোণমুখ ’ ও ‘ সংগ্রহণ ’ নামে তিনটি নিম্ন বিচারালয়ের কথা জানা যায় । অর্থশাস্ত্রে ১৮ টি দণ্ডবিধি ও ৭ রকম বেত্রাঘাতের কথা আছে । ব্যাবহারিক , মহাপাত্র , রাজুক প্রমুখ ছিলেন বিচারবিভাগের কর্মচারী ।

গুপ্তচর বিভাগ

সাম্রাজ্যের সংবাদ সংগ্রহের জন্য গুপ্তচর বিভাগ ছিল । স্থায়ী গুপ্তচরদের ‘ সমস্থা ’ ও ভ্রাম্যমাণ গুপ্তচরদের ‘ সঞ্চরা ’ বলা হত ।

রাজস্ব ব্যবস্থা

মৌর্য রাজারা রাজস্ব , জলকর , বিক্রয়কর ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের কর আদায় করতেন । উৎপন্ন শস্যের ৬ ভাগের ১ ভাগ বা এক ভাগের চার ভাগ রাজস্ব আদায় করা হত । উপকর ছিল ‘ বলি ‘ । মৌর্য যুগে পর্যাপ্ত রৌপ্য মুদ্রার প্রচলন ছিল ।

অশােকের শাসন সংস্কার

মূল শাসন ব্যবস্থাকে অপরিবর্তিত রেখে অশােক কিছু সংস্কার করেন । যেমন—

( i ) রাজুক , যুত , মহামাত্র ও ধর্মমহামাত্র নামে চার শ্রেণির কর্মচারী নিয়ােগ করেন ।

( ii ) তিন অথবা পাঁচ বছর অন্তর কর্মচারীদের অনুসংযানের নির্দেশ দেন ।

( ii ) স্ত্রীজাতির তত্ত্বাবধানের জন্য ‘ স্ত্রী – অধ্যক্ষ মহামাত্র ’ নামে নতুন কর্মচারী নিয়ােগ করেন ।

( iv ) বিচারের ক্ষেত্রে ‘ দণ্ডসমতা ’ ও ‘ ব্যবহারসমতা ’ নীতির প্রবর্তন করে প্রচলিত দণ্ডবিধির কঠোরতা কিছুটা হ্রাস করেন ।

( v ) মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা প্রাপ্ত ব্যক্তিকে আত্মশুদ্ধির সুযােগ দেন ।

অনিয়ন্ত্রিত স্বৈরতন্ত্র 

মৌর্য শাসনব্যবস্থাকে ঐতিহাসিক ভি. স্মিথ  অনিয়ন্ত্রিত ’ বা ‘ বল্গাহীন স্বৈরতন্ত্র ’ বলেছেন । মৌর্য শাসনব্যবস্থায় রাজার একক আধিপত্য এবং ক্ষমতাহীন মন্ত্রীপরিষদ রাজাকে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী করেছিল বলে স্মিথ মনে করেন । কিন্তু হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী , রােমিলা থাপার  প্রমুখ স্মিথের বক্তব্য মানতে অস্বীকার করেছেন । তাঁদের মতে , মৌর্য যুগে রাজা স্বৈরাচারী ক্ষমতার আধার হলেও স্বেচ্ছাচারী ছিলেন না । রাজক্ষমতা নিরঙ্কুশ হলেও তা বল্গাহীন বা অনিয়ন্ত্রিত ছিল না । তাঁদের যুক্তিগুলি হল

( i ) সেকালে প্রচলিত রীতিনীতি বা ‘ পােরান পকিতি ’ রাজার কাজের ওপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলত । রাজা দীর্ঘদিনের প্রচলিত সামাজিক আইনকানুন , রীতিনীতি অগ্রাহ্য করতে পারতেন না ।

( ii ) মন্ত্রীপরিষদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ রাজার ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক না হলেও , জরুরি অবস্থায় রাজা মন্ত্রীপরিষদের সিদ্ধান্ত মান্য করতেন বলে কৌটিল্য উল্লেখ করেছেন ।

( iii ) মৌর্য যুগে নগর ও গ্রামগুলি , বহুল পরিমাণে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার ভােগ করত । কিছু স্বশাসিত উপজাতির উল্লেখ অ্যারিয়ানের রচনা থেকে পাওয়া যায় । এই ব্যবস্থা উদারতার নিদর্শন ।

( iv ) সম্রাট অশােক তাঁর রাজকর্তব্যের মধ্যে পিতৃতান্ত্রিক আদর্শ সংযােজন করেছিলেন । পিতা পুত্রের সঙ্গে শাসক – শাসিতের কল্পনায় স্বেচ্ছাচারিতার স্থান নেই ।

( v ) কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে রাজাকে কর্তব্যপরায়ণ , গুণবান ও প্রজানুরাগী হতে নিদের্শ দিয়েছেন । এই বিধান অমান্য করা সম্ভব ছিল বলে মনে হয় না । অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে , মৌর্য শাসনব্যবস্থায় স্বৈরতন্ত্র ও কল্যাণমুখী রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয় ঘটানাে হয়েছিল ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!