বিজেতা ও শাসক রূপে সমুদ্র গুপ্তের কৃতিত্ব
Contents
বিজেতা ও শাসক রূপে সমুদ্র গুপ্তের কৃতিত্ব
প্রথম চন্দ্রগুপ্তের মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন তাঁর পুত্র সমুদ্রগুপ্ত ( ৩৩০-৩৮০ খ্রিঃ ) । সমুদ্রগুপ্ত ছিলেন গুপ্তবংশের শ্রেষ্ঠ শাসক । তাঁর সভাকবি হরিষেণ রচিত ‘ এলাহাবাদ প্রশস্তি ’ থেকে সমুদ্রগুপ্তের রাজত্বকালের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় ।

সমুদ্র গুপ্তের উত্তর ভারত বিজয়
সমুদ্রগুপ্ত প্রথমে উত্তর ভারতের বিরুদ্ধে অভিযান চালান । আর্যাবর্ত বা উত্তর ভারতের বহু রাজাকে তিনি রাজ্যচ্যুত করতে সক্ষম হন । পরাজিত রাজাদের মধ্যে ছিলেন অচ্যুত , নাগসেন , মতিল , নাগদত্ত , চন্দ্রবর্মন , গণপতিনাগ , নন্দী , রুদ্রদেব ও বলবর্মন । মােটামুটিভাবে বলা যায় , এইসব রাজা পাঞ্জাব , উত্তরপ্রদেশ , মধ্য ভারতের কিয়দংশ এবং বাংলা দেশের দক্ষিণ – পশ্চিম অঞ্চলে রাজত্ব করতেন । এইসব অঞ্চল দখল করে সমুদ্রগুপ্ত প্রত্যক্ষ শাসন প্রবর্তন করেন । এরপর তিনি উত্তরপ্রদেশের গাজীপুর ও মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুরের মধ্যবর্তী অঞ্চলের জঙ্গলের অধিপতিদের পরাস্ত করেন ।
সমুদ্র গুপ্তের দক্ষিণ ভারত বিজয়
উত্তর ভারতের পর তিনি দক্ষিণ ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন । দক্ষিণ ভারতের যেসমস্ত রাজাকে সমুদ্রগুপ্ত পরাজিত করেছিলেন , তাঁদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য কয়েকজন হলেন মহেন্দ্র ( কোশল ) ; বিষ্ণুগােপ ( কাঞি ) ; ব্যাঘ্ররাজ ( মহাকান্তা ) ; ধনঞ্জয় ( কুন্তলাপুর ) ; হস্তীবর্মন ( বেঙ্গি ) ; স্বামীদত্ত ( কোত্তর ) ; নীলরাজ ( অভমুক্তা ) ; উগ্রসেন ( পলাক্কা ) প্রমুখ । তবে দক্ষিণ ভারতের রাজাদের পরাজিত করলেও সমুদ্রগুপ্ত তাঁদের রাজ্য নিজের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেননি । আনুগত্যের বিনিময়ে তাদের নিজ নিজ রাজ্য ফিরিয়ে দিয়েছিলেন । ‘এলাহাবাদ প্রশস্তি’তে এই নীতিকে গ্রহণ পরিমােক্ষ বলা হয়েছে । এই নীতি অনুসারে সমুদ্রগুপ্ত প্রথমে গ্রহণ অর্থাৎ শত্রুকে বলপূর্বক বন্দি করেন । তারপর মােক্ষ অর্থাৎ তাকে মুক্তি দেন । এবং সর্বশেষে অনুগ্রহ অর্থাৎ পরাজিত শত্রুকে অনুগ্রহ করে হৃতরাজ্য ফিরিয়ে দেন । অবশ্য পরাজিত শত্রুকে শ্রী অর্থাৎ সার্বভৌম ক্ষমতা তিনি ফিরিয়ে দেননি । সম্ভবত সুদুর পাটলিপুত্র থেকে দক্ষিণ ভারতের ওপর নিরঙ্কুশ প্রাধান্য রক্ষা করা যাবে না ভেবেই তিনি এই সিদ্ধান্ত নেন । তবে রােমিলা থাপারের মতে , দক্ষিণ ভারতের রাজারা সমুদ্রগুপ্তকে যথেষ্ট বাধা দিয়েছিলেন । তাঁদের সাহস ও স্বাধীনতাবােধ দেখে সমুদ্রগুপ্ত তাঁদের আনুগত্য পেয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন ।
সমুদ্র গুপ্তের সীমান্ত অঞ্চল দখল
উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে সমুদ্রগুপ্তের সাফল্যে প্রত্যন্ত বা সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলি ভীত হয়ে উঠেছিল । তাদের অনেকেই স্বেচ্ছায় তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে এবং কর দিতে রাজি হয় । এই রাজ্যগুলি হল সমতট , দবাক , কামরূপ , নেপাল ও কীর্তিপুর । পাঞ্জাব ও রাজস্থানের কয়েকটি উপজাতি গণরাজ্য , যেমন — মালব , অর্জুনায়ণ , যৌধেয় , মদ্রক , আভীর , সনকানিক , কাক , খরপরিক প্রভৃতি তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে করদানে সম্মত হয় ।
সমুদ্র গুপ্তের বিদেশে কর্তৃত্ব বিস্তার
সমুদ্রগুপ্তের খ্যাতি ভারতের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছিল । সিংহলের রাজা মেঘবর্ণ তাঁর রাজসভায় একজন দূত পাঠান এবং বুদ্ধগয়ায় একটি বিহার নির্মাণের অনুমতি লাভ করেন । মালয় , যবদ্বীপ , সুমাত্রা এবং পূর্ব – ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের হিন্দু – উপনিবেশগুলির ওপরেও সম্ভবত সমুদ্রগুপ্তের কিছুটা নিয়ন্ত্রণ ছিল । উত্তর – পশ্চিম সীমান্তের শক ও কুষাণবংশীয় শাসকেরাও সমুদ্রগুপ্তের কর্তৃত্ব স্বীকার করে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখেন ।
সমুদ্র গুপ্তের অশ্বমেধ যজ্ঞ
এইভাবে সমগ্র উত্তর ভারত , পাঞ্জাব , উত্তর – পশ্চিম সীমান্তপ্রদেশ , কাশ্মীর , সিন্ধু , পশ্চিম রাজস্থান ও গুজরাট ছাড়া মধ্যপ্রদেশ ও উড়িষ্যার মালভূমি অঞ্চল এবং দক্ষিণে মাদ্রাজ শহর পর্যন্ত সমুদ্রগুপ্ত নিজের সাম্রাজ্য প্রসারিত করেন । দক্ষিণ ভারত বিজয় সম্পূর্ণ করে সমুদ্রগুপ্ত অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়ােজন করেন । এই উপলক্ষ্যে তিনি বিশেষ একধরনের স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন করেন । এই মুদ্রার একদিকে ছিল যজ্ঞের ঘােড়ার প্রতিকৃতি ও অপরদিকে ছিল রাজমহিষী দত্তাদেবীর প্রতিকৃতি । এ ছাড়া নিজের সার্বভৌম ক্ষমতার প্রমাণস্বরূপ সমুদ্রগুপ্ত সর্বরাজোচ্ছেত্তা , অপ্রতিরথ প্রভৃতি উপাধি গ্রহণ করেছিলেন । সমুদ্রগুপ্তের সামরিক প্রতিভার প্রশংসা করতে গিয়ে ঐতিহাসিক স্মিথ তাঁকে ভারতীয় নেপােলিয়ন ( Indian Napoleon ) বলে অভিহিত করেছেন ।
সমুদ্রগুপ্তের শাসন দক্ষতা
কেবল সুযোদ্ধা নয় , সুশাসক হিসেবেও সমুদ্রগুপ্তের যথেষ্ট খ্যাতি ছিল ।
( i ) তিনি ছিলেন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন শাসক । তাই অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত উত্তরের রাজ্যগুলিকে তিনি প্রত্যক্ষ শাসনের অধীনে এনেছিলেন । কিন্তু দূরবর্তী দক্ষিণের রাজ্যগুলি জয় করে অধীনতার বিনিময়ে সেইসব রাজাদের আবার নিজ নিজ রাজ্য ফিরিয়ে দেন ।
( ii ) তিনি বৈদেশিক প্রভাবমুক্ত এক সম্পূর্ণ ভারতীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন । তাঁর শাসনে রাজার একচ্ছত্র আধিপত্য থাকলেও রাজা ছিলেন প্রজানুরঞ্জক । তাঁর সুশাসনে দেশের সুখ , স্বাচ্ছন্দ্য ও সংহতি অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল ।
( iii ) মুদ্রা প্রণয়নের ক্ষেত্রেও তিনি বিশিষ্টতার স্বাক্ষর রাখেন । সমুদ্রগুপ্ত সম্পূর্ণ বিদেশি প্রভাবমুক্ত মুদ্রার প্রচলন করেন ।
( iv ) বিদ্যোৎসাহী , সু-কবি ও সংগীতজ্ঞরূপেও তাঁর যথেষ্ট খ্যাতি ছিল । তিনি বহু কাব্য রচনা করেছিলেন । বীণাবাদনরত মুর্তিসম্বলিত মুদ্রা থেকে সমুদ্রগুপ্তের সংগীতপ্রীতির পরিচয় পাওয়া যায় । ‘এলাহাবাদ প্রশস্তি’তে তাঁকে কবিরাজ বলে অভিহিত করা হয়েছে । বিদ্বানদের প্রতি ছিল তাঁর গভীর শ্রদ্ধা । সমুদ্রগুপ্তের মন দয়ায় পরিপূর্ণ ছিল । শাস্ত্রতত্ত্বে তাঁর বিশেষ জ্ঞান ছিল । হরিষেণ তাঁকে এই কারণে নারদ ও বৃহস্পতির সঙ্গে তুলনা করেছেন ।
( v ) ধর্মবিষয়ে তিনি ছিলেন উদার । ব্রাহ্মণ্যধর্মাবলম্বী হলেও তিনি অন্যান্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন । সিংহলরাজ মেঘবর্ণকে বােধগয়ায় বৌদ্ধমঠ নির্মাণের অনুমতি দান বা বৌদ্ধশাস্ত্রজ্ঞ বসুবন্ধুকে উচ্চ রাজপদে নির্বাচন তাঁর পরধর্মসহিষ্ণুতার পরিচয় ।
( vi ) সুশাসক ও সমরকুশলী নেতা হিসেবে সমুদ্রগুপ্তের নাম ভারত – ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে । দীর্ঘ বিশৃঙ্খলার পর রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপন করে এবং শিক্ষা – সংস্কৃতির পৃষ্ঠপােষকতা দ্বারা তিনি ভারতে এক নবজীবনের সূচনা করেন । ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে , সমুদ্রগুপ্ত ভারত – ইতিহাসে একজন স্মরণীয় ও অনুপম শাসক । ভারত – ইতিহাসে তিনি এক নবযুগের উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন ( There can be no doubt that Samudra gupta was a striking , almost unique personality . He ushered a new age in the history of India ) ভি. স্মিথ তাই সমুদ্রগুপ্তকে ভারত – ইতিহাসে একজন স্মরণীয় শাসকরূপে চিহ্নিত করেছেন ( ” Samudra gupta … was one of the most remarkable and accomplished kings recorded in Indian history ” )।
nice note
3 semester