ইতিহাস

ভারতবর্ষে আধুনিক শিল্পের বিকাশে ইউরোপীয়দের অবদান

Contents

ভারতবর্ষে আধুনিক শিল্পের বিকাশে ইউরোপীয়দের অবদান

ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ভারতবর্ষে কৃষি ভিত্তিক অর্থনীতির বুনিয়াদ শিল্প ভিত্তিক স্তরে উন্নীত হলে ভারতীয় অর্থনীতিতে পরিবর্তনের ঢেউ আসে । কোম্পানির শাসকবর্গ দেশীয় মালিকানায় ভারতে‌ আধুনিক শিল্প বিকাশের বিরােধী ছিল । কোম্পানির এই একপেশে শিল্প নীতির সুযােগ নিয়ে ইউরােপীয় পুঁজিপতি গােষ্ঠী ভারতের শিল্পোন্নয়নের নয় , শুধুমাত্র নিজেদের মুনাফা অর্জনের জন্যই অর্থ বিনিয়ােগ করেছিল ।

images 5
ইউরােপীয়দের অবদান

ইউরোপীয়দের পাট শিল্পে অবদান

প্রথম দিকে ইউরােপীয় উদ্যোগ কেন্দ্রীভূত ছিল পাট ও কয়লা শিল্পে । কলকাতার কাছে রিষড়ায়  ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতের প্রথম চটকলটি স্থাপন করেন জর্জ অকল্যান্ড নামে ব্রিটিশ বাণিজ্যের একজন উচ্চপদস্থ আধিকারিক । ১৯১৩ – ১৪ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মােট পাটকলের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৪টি । পাটশিল্পকে সু–সংগঠিত করার লক্ষ্যে গঠিত হয় জুট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসােসিয়েশন ( ১৮৮৪ খ্রি. ) , যা ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে ইন্ডিয়ান জুট মিলস অ্যাসােসিয়েশন নামে পরিচিতি পায় ।

ইউরোপীয়দের কয়লা শিল্পের অবদান

কয়লা শিল্পে ইউরােপীয় উদ্যোগের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল আলেকজান্ডার অ্যান্ড কোম্পানি , বরাকর কোল কোম্পানি , বেঙ্গল কোল কোম্পানি প্রভৃতি । রানিগঞ্জে প্রথম সংগঠিত ভাবে কয়লা উত্তোলনের কাজ শুরু হয় ( ১৮২০ খ্রি. ) । ১৮৫৪ খ্রি. শুধুমাত্র বাংলা – বিহারে যেখানে কয়লা খনির সংখ্যা ছিল তিনটি , সেখানে ইউরােপীয়দের উদ্যোগের ফলে ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তা বেড়ে হয় ছাপ্পান্নটি ।

ইউরোপীয়দের কাগজ শিল্পে অবদান

ইউরােপীয় প্রচেষ্টায় হুগলি নদীর তীরে বালিতে প্রথম যন্ত্রোৎপাদিত কাগজের উৎপাদনও শুরু হয় ( ১৮৭০ খ্রি. ) । এরপর লক্ষ্ণৌ ( ১৮৭৯ খ্রি. ) , টিটাগড় ( ১৮৮২ খ্রি. ) , রানিগঞ্জে ( ১৮৮৯ খ্রি. ) কাগজকল স্থাপিত হয় । এ ছাড়াও পরবর্তী সময়ে ইউরােপীয় উদ্যোগে ভদ্রাবতীতে  ‘ মহীশুর পেপার মিল ‘ ( ১৯৩৯ খ্রি. ) , হায়দ্রাবাদে ‘ শিবপুর পেপার মিল ‘ ( ১৯৪২ খ্রি. ) গড়ে ওঠে ।

ইউরোপীয়দের বাগিচা শিল্পে অবদান

নীল , কফি , চা ইত্যাদি বাগিচা শিল্পপণ্য উৎপাদন শিল্পেও ইউরােপীয় প্রচেষ্টা স্মরণযােগ্য । রবার্ট ব্রুস প্রথম আসামের জঙ্গলে চা গাছ আবিষ্কার করেন ( ১৮২৩ খ্রি. ) । এন্ড্রু চার্লটন এদেশে প্রথম চা গাছ রােপণ করেন ( ১৮৩২ খ্রি. ) । লুই বােনার প্রথম হুগলির চন্দননগরে নীল গাছ রােপণ করেন ( ১৭৭৭ খ্রি. ) । ব্রিটিশ প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে ‘ আসাম টি কোম্পানি ‘ ( ১৮৩৯ খ্রি. ) । ইউরােপীয় মালিকানাধীনে নীলগিরি অঞ্চলে প্রথম  কফিচাষ শুরু হয় ( ১৮২৩ খ্রি. ) । ইউরােপীয় মূলধনে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে এদেশে প্রথম চিনিকলটি স্থাপিত হয় ।

ইউরোপীয়দের চর্ম শিল্পে অবদান

কোম্পানির প্রচেষ্টায় মাদ্রাজে দেশের বৃহত্তম চর্ম শিল্পকেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠিত হয় ( ১৮৫৫ খ্রি. ) । সেনাবাহিনীকে জুতাে সরবরাহের লক্ষ্যে কানপুরে গড়ে ওঠে  ‘ হার্নেস অ্যান্ড স্যাডলারি ফ্যাক্টরি ‘ ( ১৮৬০ খ্রি. ) । চর্ম শিল্পের সামগ্রিক উন্নতিসাধনের লক্ষ্যে সরকারি তরফে ‘ হাইডস সেস এনকোয়ারি কমিটি ‘ গঠন করা হয় ( ১৯৩০ খ্রি. )।

ইউরোপীয়দের লৌহ ইস্পাত শিল্পে অবদান

ভারতে লৌহ – ইস্পাত শিল্পে ইউরােপীয় উদ্যোগপতিদের মধ্যে প্রথম অর্থ বিনিয়ােগ করেছিল মেসার্স মট অ্যান্ড ফারকুহার সংস্থা । মাদ্রাজের পাের্টানােভায় প্রথম ১৮৩০ খ্রি. জোসিয়া মার্শাল হিথ নামে এক প্রাক্তন ইংরেজ কর্মচারীর উদ্যোগে প্রথম লৌহ – ইস্পাত কারখানা স্থাপিত হয় ।

ইউরোপীয়দের বস্ত্র শিল্পে অবদান

ভারতে কার্পাস বস্ত্র শিল্পকেন্দ্রটি প্রথম ইউরােপীয়দের উদ্যোগেই গড়ে ওঠে । ১৮১৮ খ্রি. গঠিত হয়েছিল হাওড়ার বাউরিয়া কটন মিল , ১৮৩০ খ্রি. ফরাসি উদ্যোগে পণ্ডিচেরিতে এবং ১৮৫৩ খ্রি. জেমস ল্যান্ডন নামে জনৈক ইংরেজ শিল্পপতিদের প্রয়াসে ব্রোচে একটি সুতাকাটা কল স্থাপিত হয় ।

ভারতবর্ষে ইউরোপীয় শিল্প উদ্যোগের সমালোচনা

ভারী ও মূলধন – সৃষ্টিকারী শিল্প , যেমন যন্ত্রপাতি , লৌহ ইত্যাদি এদেশে গড়ে উঠুক ব্রিটিশ সরকার তা চাইত না । কারণ তাদের ভয় ছিল ভারতে , বিশেষ করে ভারতীয় মালিকানাধীনে আধুনিক শিল্প গড়ে উঠলে ভারতের বাজার ও কাঁচামাল — দুইই তাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে । তাই এদেশে ব্রিটিশ পুঁজির যতটুকু বিনিয়ােগ করা হয়েছিল তার বেশিরভাগই ভােগ্যপণ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিল্পের বিকাশের ক্ষেত্রেই করা হয়েছিল । তাই প্রাক – প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে এদেশে আধুনিক শিল্পবিকাশের গতি ছিল খুবই ধীর । রমেশচন্দ্র দত্তের  মতে — ব্রিটিশ সরকারের অনুদার শিল্পনীতির ফলে ভারতে শিল্প বিপ্লব ঘটেনি ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!