স্পিয়ারম্যানের দ্বি উপাদান তত্ত্ব
Contents
স্পিয়ারম্যানের দ্বি উপাদান তত্ত্ব
ব্রিটিশ মনোবিদ চার্লস স্পিয়ারম্যান ১৯০৪ সালে “ American Journal of Psychology ” তে “ General Intelligence objectively determined and measured ” – এই শিরোনামে মানসিক ক্ষমতা সম্পর্কিত দ্বি উপাদান তত্ত্বটি প্রথম প্রকাশ করেন । স্পিয়ারম্যানের তত্ত্বটি প্রাচীন রাজতন্ত্রবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত । কিন্তু তিনি তাঁর এই তত্ত্বটিকে পরীক্ষামূলক ও গাণিতিক পর্যবেক্ষণ মূলক যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন ।
দ্বি উপাদান তত্ত্বের মূল বক্তব্য
স্পিয়ারম্যান বহু শিক্ষার্থী এবং ছেলেমেয়েদের বৌদ্ধিক কর্ম সম্পাদনের প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করে বলেন , যে কোনো ধরনের বৌদ্ধিক কাজ করতে গেলে দু ধরনের মানসিক উপাদানের প্রয়োজন হয় , তা হল :
A. সাধারণ মানসিক ক্ষমতা ( General Mental ability , G-factor ) ।
B. বিশেষ মানসিক ক্ষমতা ( Special Mental ability , S-factor ) ।
সাধারণ মানসিক ক্ষমতা
যে জন্মগত মানসিক ক্ষমতা সবরকম বৌদ্ধিক কাজ করতে প্রয়োজন হয় এবং যা পরিবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গে ব্যক্তিকে মানিয়ে নিয়ে চলতে সাহায্য করে , তাই হল সাধারণ মানসিক ক্ষমতা ।
সাধারণ মানসিক ক্ষমতার বৈশিষ্ট্য :
( ১ ) সাধারণ মানসিক ক্ষমতা জন্মগত ।
( ২ ) সবরকমের বৌদ্ধিক কাজের জন্য প্রয়োজন ।
( ৩ ) এই মানসিক ক্ষমতা প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রে কম বেশি বর্তমান ।
( ৪ ) এই মানসিক ক্ষমতা পরিমাপযোগ্য ।
বিশেষ মানসিক ক্ষমতা
যে মানসিক ক্ষমতা বিশেষ বিশেষ কাজের জন্য প্রয়োজন হয় যা অনুশীলন নির্ভর এবং সাধারণ মানসিক ক্ষমতার ওপর নির্ভরশীল তাকে বলা হয় বিশেষ মানসিক ক্ষমতা ।
সাধারণ মানসিক ক্ষমতার বৈশিষ্ট্য :
( ১ ) এটি একটি বিশেষধর্মী মানসিক ক্ষমতা । নির্দিষ্ট কাজ করার ক্ষেত্রে এই ক্ষমতা ব্যবহৃত হয় ।
( ২ ) বিশেষ মানসিক ক্ষমতা অর্জিত ।
( ৩ ) বিশেষ মানসিক ক্ষমতা সংখ্যায় অনেক ।
( ৪ ) এটি সবসময় সাধারণ মানসিক ক্ষমতার ওপর নির্ভরশীল ।
( ৫ ) এই মানসিক ক্ষমতা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন ।
( ৬ ) কোনো কোনো বিশেষ মানসিক ক্ষমতা এক বিষয় থেকে অন্য বিষয়ে সঞ্চালিত বা স্থানান্তরিত হতে পারে ।
স্পিয়ারম্যান তাঁর তত্ত্বকে দুইভাবে ব্যাখ্যা করেছেন ।
দ্বি উপাদান তত্ত্বের গাণিতিক ব্যাখ্যা
স্পিয়ারম্যান তাঁর তত্ত্বে রাশি বিজ্ঞানের পদ্ধতি প্রয়োগ করেন । তিনি বিভিন্ন বৌদ্ধিক কাজ করার ক্ষমতাকে সংখ্যাগত ভাবে পরিমাপ করে তার মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ণয় করেন । এই সম্পর্ককে রাশিবিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় সহগতি ( co-relation ) , বিশ্ব জগতে একটি বস্তু অপর একটি বস্তুর সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত । বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় দুটি চলের মধ্যে যদি এমন কোনো সম্পর্ক বর্তমান থাকে যে , একটির কোনো প্রকার পরিবর্তন ঘটলে অপরটির মধ্যে একটি পরিবর্তন হবে । তখন এই সম্পর্ককে বলা হয় অনুবন্ধন বা সহগতি ।
এই সহগতি তিন ধরনের –
( ১ ) ধনাত্মক সহগতি ( Positive Co-relation )
( ২ ) ঋণাত্মক সহগতি ( Negative Co-relation )
( ৩ ) শূন্য সহগতি ( Zero Co-relation )
ধনাত্মক সহগতি :
দুটি সম্বন্ধযুক্ত চলের ক্ষেত্রে একটির হ্রাস বা বৃদ্ধি ঘটলে অপরটির হ্রাস বা বৃদ্ধি ঘটে থাকে । যেমনঃ তাপমাত্রা ও থার্মোমিটারের পারদের উচ্চতা , বৃষ্টি ও জলস্তর ইত্যাদি ।
ঋণাত্মক সহগতি :
দুটি সম্বন্ধযুক্ত চলের মধ্যে একটির বৃদ্ধি বা হ্রাসের জন্য অপরটির হ্রাস বা বৃদ্ধি ঘটে । অর্থাৎ , দুটি চলের মধ্যে হ্রাস বা বৃদ্ধি দেখা যায় , একে বলা হয় ঋণাত্মক সহগতি । যেমনঃ ওপরের দিকে ছোঁড়া বস্তুর বেগ ও সময় ।
শূন্য সহগতি :
যখন দুটি চলের একটির পরিবর্তন অপরটির পরিবর্তনে কোনো প্রভাব ফেলে না , এ ধরনের সহগতিকে বলা হয় শূন্য সহগতি । যেমনঃ বুদ্ধির সঙ্গে জুতোর মাপ , বাড়িতে গোলাপ ফুল ফোটা ও কলেজ যাওয়া ইত্যাদি । সুতরাং , এই পৃথিবীতে যে কোনো দুটি ঘটনাকে এই তিন প্রকার সহগতির যে কোনো একটি দিয়ে প্রকাশ করা যায় ।
রাশিবিজ্ঞানে সহগতির মান নির্ণয় করার জন্য সংখ্যা মান ব্যবহার করা হয় । এই সংখ্যা মানকে বলা হয় সহগতির সহগাঙ্ক ( Co-efficient of co-relation ) Co-efficient of co-relation বা সহগতির সহগাঙ্ককে ইংরেজির ( r ) দ্বারা প্রকাশ করা হয় ।
স্পিয়ারম্যান বিভিন্ন বৌদ্ধিক কাজে পারস্পরিক সহগতি নির্ণয় করে দেখলেন যে তা একটি বিশেষ নিয়ম মেনে চলে । এই নিয়মকে তিনি বিশেষ একটি সমীকরণ দ্বারা প্রকাশ করেন । সমীকরণটির নাম দেন টেট্রাড সমীকরণ । ধরা যাক , এখানে a , b , c , d এই চারটি বৌদ্ধিক কাজের মধ্যে সহগতির সহগাঙ্ককে সমীকরণ দ্বারা প্রকাশ করা হল-
rab x rcd x 一 rad x rbc = 0
এই সমীকরণে নির্ণেয় সহগতির টেট্রাড অন্তরগুলির মান শূন্য বা প্রায় শূন্য হয় ।
গাণিতিক ব্যাখ্যার সিদ্ধান্ত :
স্পিয়ারম্যান গাণিতিক ব্যাখ্যার দ্বারা সিদ্ধান্ত করেছেন যে , যেহেতু বৌদ্ধিক কাজের মধ্যে পারস্পরিক সহগতির সহগাঙ্ক টেট্রাড সমীকরণ মেনে চলে সেহেতু তাদের প্রত্যেকের মধ্যে একটি সাধারণ মানসিক উপাদান বর্তমান । প্রত্যেক কাজের মধ্যে আর একটি বিশেষ মানসিক উপাদান বর্তমান । তিনি সাধারণ মানসিক ক্ষমতাকে বুদ্ধি হিসেবে বিবেচনা করেছেন । বুদ্ধি হল এমন এক সর্বজনীন সাধারণ মানসিক ক্ষমতা যা মানুষের সবরকম বিচার বুদ্ধি সম্পন্ন কাজে ব্যবহৃত হয় ।
দ্বি উপাদান তত্ত্বের জ্যামিতিক ব্যাখ্যা
স্পিয়ারম্যান তাঁর মানসিক ক্ষমতার তত্ত্বকে গাণিতিক ব্যাখ্যার সঙ্গে সঙ্গে জ্যামিতিক ব্যাখ্যাও দিয়েছেন । এখানে চিত্রসহ নিম্নে তা আলোচনা করা হল –

চিত্র অনুযায়ী বড়ো বৃত্তটি হল সাধারণ উপাদান বা G উপাদান এবং ছোটো ছোটো উপবৃত্তগুলি বিশেষ মানসিক উপাদান বা S উপাদান । বিশেষ মানসিক উপাদানগুলি হল Sa , Sb , SccSd , চিত্রে দেখা যাচ্ছে প্রতিটি বিশেষ কাজের জন্য G প্রয়োজন হয়েছে । কিন্তু সবক্ষেত্রে সমপরিমাণ G প্রয়োজন হয় না ।
অর্থাৎ বিভিন্ন কাজ G সম্পৃক্ততার দিক থেকে ভিন্ন এখানে Sa এই বিশেষ কাজটির জন্য যে পরিমাণ সাধারণ উপাদানের প্রয়োজন হয়েছে ( G ) Sb কাজটির জন্য তার চেয়ে কম G উপাদানের প্রয়োজন হয়েছে অর্থাৎ , Sb কাজের চেয়ে Sa এই কাজটির G সম্পৃক্ততা বেশি । Sb এই বিশেষ কাজটিতে যে পরিমাণ G প্রয়োজন হয়েছে তার চেয়ে Sc এই বিশেষ কাজটির জন্য G এর প্রয়োজন বেশি হয়েছে । তাই বলা যায় Sc কাজটির জন্য G সম্পৃক্ততার চেয়ে Sb কাজটির জন্য G সম্পৃক্ততা কম । অর্থাৎ , যে কাজের জন্য G উপাদান বেশি লাগবে সেই কাজগুলির G সম্পৃক্ততা বেশি হবে । অর্থাৎ , সহগতির সহগাঙ্ক বেশি ।
স্পিয়ারম্যানের দ্বি উপাদান তত্ত্ব এর সমালোচনা
স্পিয়ারম্যানের দ্বি উপাদান তত্ত্বকে বিভিন্ন মনোবিদ সমালোচনা করেছেন –
থাস্টোন : থাস্টোন G উপাদানের অস্তিত্বকে অস্বীকার করেছেন । তিনি বলেছেন যদি বিভিন্ন বুদ্ধিমূলক কাজের মধ্যে সহগতি থাকে তবে সেই সহগতির পরিমাণ এতই সামান্য যে তার ওপর উপাদানের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায় না ।
তিনি আরও বলেছেন স্পিয়ারম্যানের সাধারণ উপাদানের প্রকৃত স্বরূপ ব্যাখ্যা করা হয়নি ।
টমসন বলেছেন , আমাদের সকল বুদ্ধিমূলক কাজের মধ্যে একটি সাধারণ উপাদান কাজ করে তা বলা যায় না । কারণ কতগুলি উপাদান বা ক্ষমতা দলবদ্ধ হয়ে থাকে । এই দলগত উপাদানগুলি বিভিন্ন বৌদ্ধিক কাজের মাধ্যমে প্রকাশ পায় ।
অন্যান্য মনোবিদ : স্পিয়ারম্যানের তত্ত্বে বিশেষ উপাদান বুদ্ধির অন্তর্ভুক্ত নয় । কারণ বিশেষ উপাদানগুলি কর্ম সম্পাদনে ব্যবহৃত হলেও সর্বজনীন নয় । তাই তারা বলেছেন , স্পিয়ারম্যানের দ্বি উপাদান তত্ত্ব মূলত এক উপাদান তত্ত্ব ।
দ্বি উপাদান তত্ত্বের সংশোধিত রূপ
স্পিয়ারম্যান ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর তত্ত্বের সংশোধিত রূপ প্রকাশ করেন এবং এখানে একটি উপাদানের কথা উল্লেখ করেন । এই উপাদানের নামকরণ করেন দলগত উপাদান ( Group factor ) । নিম্নে চিত্রের সাহায্যে দেখানো হল –

তিনি বলেছেন যে দক্ষতা বা উপাদান একের বেশি বৌদ্ধিক কাজে ব্যবহৃত হয় অথচ সাধারণ উপাদানের মতো সব কাজে ব্যবহৃত হয় না , তাই হল দলগত উপাদান বা Group factor । চিত্রে দেখানো হয়েছে সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে S1 + S2 + G এর কিছুটা প্রয়োজন । S1 হল ভাষায় দক্ষতা , S2 হল চিন্তা করার দক্ষতা প্রকাশ করা হয়েছে । অর্থাৎ বিভিন্ন কাজের জন্য প্রয়োজনীয় একই রকম বিশেষ উপাদান দলগত উপাদানের সৃষ্টি করে ।