মনোযোগের নির্ধারক
Contents
মনোযোগের নির্ধারক
আমাদের চারপাশে অসংখ্য বস্তুর মধ্য থেকে বিশেষ একটিকে নির্বাচন করে , তার প্রতি আমরা মনোযোগ দিয়ে থাকি । ওই বিশেষ বস্তুটিকে কেন নির্বাচন করছি , সেই কারণগুলি হল মনোযোগের নির্ধারক । সাধারণভাবে যে শর্তগুলি বস্তু নির্বাচনে সহায়তা করে সেগুলি হল মনোযোগের নির্ধারক । মনোবিদগণ মনোযোগের নির্ধারকগুলিকে দুটি ভাগে ভাগ করেছেন ।
( i ) বস্তুগত / বাহ্যিক নির্ধারক ( objective / External Determinants )
( ii ) ব্যক্তিগত / অভ্যন্তরীণ ( Subjective / Internal Determinants )
বস্তুগত / বাহ্যিক নির্ধারক ( Objective / External Determinants )
যখন কোনো বস্তুর কোনো বৈশিষ্ট্যের জন্য আমরা মনোযোগ দিই তখন সেইগুলিকে বলা হয় বস্তুগত নির্ধারক । বস্তুগত নির্ধারকগুলি হল –
তীব্রতা ( Intensity ) :
উদ্দীপকের মধ্যে যেটি সবচেয়ে বেশি তীব্র , যেটির প্রতি সহজেই আমরা মনোযোগী হই । যেমন – উজ্জ্বল আলো , গাঢ় রং , তীব্র গন্ধ , জোর শব্দ প্রভৃতির দিকে আমাদের মনোযোগ সহজেই ধাবিত হয় ।
আকার ( Size ) :
সাধারণত ছোটো বস্তুর চেয়ে বড়ো বস্তু সহে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে । যেমন – বাস ও ট্রেনের মধ্যে ট্রেনটি সহজেই আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে ।
পুনরাবৃত্তি ( Repitation ) :
পুনরাবৃত্তি মনোযোগের একটি অন্যতম শর্ত বা নির্ধারক । কোনো একটি উদ্দীপকের বারবার পুনরাবৃত্তি ঘটলে আমাদের মনোযোগ সেই দিকে চালিত হয় । শিক্ষক মহাশয় যখন কোনো একটি বিষয় বারবার ব্যাখ্যা করেন তখন শিক্ষার্থীদের মনোযোগ সেই বিষয়ে ধাবিত হয় ।
পরিবর্তনশীলতা ( Change ) :
উদ্দীপকের মধ্যে আকস্মিক কোনো পরিবর্তন হলে আমাদের মনোযোগ সেই দিকে চলে যায় । নিস্তব্ধ পরিবেশ হঠাৎ কেউ রেগে উঠলে আমরা তার প্রতি মনোযোগী হই ।
গোপনীয়তা ( Secrecy ) :
গোপন বিষয়ের প্রতি আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে । কেউ যদি কোনো খবর গোপন করে তখন তার প্রতি আমরা মনোযোগী হই ।
নতুনত্ব ( Novelty ) :
নতুনত্ব মনোযোগের একটি অন্যতম নির্ধারক । তাই নতুন কোনো বিষয় আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে । যেমন – নতুন পোশাক , নতুন বই , নতুন দেশ আমাদের আকৃষ্ট করে ।
গতিশীলতা ( Movement ) :
স্থির বস্তুর তুলনায় সচল বস্তু সহজেই আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে । সকলেই হাঁটছে কিন্তু হঠাৎ একজন দৌড়াতে শুরু করল , তখন আমাদের মনোযোগ সেই দিকে চলে যাবে ।
স্পষ্টতা ( Clarity ) :
অস্পষ্ট বস্তু অপেক্ষা স্পষ্ট বস্তুর প্রতি আমরা মনোযোগী হই । শিক্ষার্থীদের খাতা দেখতে গিয়ে ভালো হাতের লেখা শিক্ষকের মনোযোগ কেড়ে নেয় ।
বিচ্ছিন্নতা ( Separation ) :
যখন কোনো একটি বস্তুকে অন্যান্য বস্তু থেকে আলাদা করা হয় তখন সেটির প্রতি আমাদের মনোযোগ যায় । অর্থাৎ , কোনো বিচ্ছিন্ন বস্তু আমাদের মনোযোগী করে ।
বৈসাদৃশ্য ( Contrast ) :
বৈসাদৃশ্য মনোযোগের একটি অন্যতম নির্ধারক । খুব ফরসা লোকের পাশে খুব কালো লোক , লম্বা লোকের পাশে বেঁটে লোককে দেখলে সহজেই আমাদের মনোযোগ সেই দিকে যায় ।
স্থায়িত্ব ( Duration ) :
মনোযোগের গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক হল উদ্দীপকের স্থায়িত্ব । উদ্দীপকের স্থায়িত্বের ওপর আমাদের মনোযোগ নির্ভর করে । আমাদের যদি কেউ বারাবার ডাকতে থাকে তখন তার প্রতি আমরা মনোযোগ দিই ।
অবস্থিতি ( Position ) :
কোনো বস্তুর বিশেষ অবস্থান আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে । সংবাদপত্রের ভেতরের পাতাগুলি থেকে আমরা প্রথম পাতার ওপরই বেশি মনোযোগ দিয়ে থাকি ।
ব্যক্তিগত নির্ধারক ( Subjective Determinants )
বস্তুর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ছাড়াও অনেক সময় আমাদের আন্তরিক অবস্থা ও চাহিদাও মনোযোগের বস্তু নির্বাচনে সাহায্য করে । যে বিশেষ মানসিক অবস্থা মনোযোগের নির্ধারক হিসেবে কাজ করে , সেগুলিকেই ব্যক্তিগত নির্ধারক বলা হয় । ব্যক্তিগত নির্ধারকগুলি সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল –
আগ্রহ ( Interest ) :
আগ্রহ হল মনোযোগের একটি অন্যতম ব্যক্তিগত নির্ধারক । ব্যক্তি যে বিষয়ে আগ্রহী সে সেই বিষয়ে মনোযোগ দিয়ে থাকে । সকালে সংবাদপত্র পাওয়ার পর যাদের রাজনীতির প্রতি আগ্রহ তারা রাজনৈতিক খবরের প্রতিই আগে মনোযোগ দেয় ।
প্রবৃত্তি ( Instincts ) :
প্রবৃত্তির তাড়নায় আমরা অনেক সময় বিশেষ কোনো বস্তুর প্রতি মনোযোগ দিয়ে থাকি । ক্ষুধার প্রবৃত্তির তাড়নায় আমরা খাদ্যবস্তুর প্রতি মনোযোগ দিয়ে থাকি ।
আবেগ ( Emotion ) :
আবেগের বশবর্তী হয়ে আমরা বিভিন্ন বস্তুর প্রতি মনোযোগ দিয়ে থাকি । যেমন – ভয় পেয়ে দৌড়ে পালানোর সময় নিকটবর্তী কোনো নিরাপদ স্থান আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে ।
মনঃপ্রকৃতি ( Temperament ) :
মনঃপ্রকৃতি হল মনোযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক । বিভিন্ন মনঃপ্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্যের জন্য ব্যক্তি বিভিন্ন ধরনের বস্তুর প্রতি মনোযোগ দিয়ে থাকে । ধার্মিক ব্যক্তিরা ধর্মীয় আলোচনা , ধর্মীয় পুস্তক , ধর্মস্থানের প্রকৃতি প্রভৃতিতে মনোযোগী হয় ।
সেন্টিমেন্ট ( Sentiment ) :
সেন্টিমেন্ট হল অর্জিত জৈব মানসিক প্রবণতা । এই জৈব মানসিক প্রবণতা ব্যক্তিকে বিভিন্ন বস্তুর প্রতি মনোযোগ দিতে সাহায্য করে ।
অভ্যাস ( Habit ) :
অভ্যাসের বশবর্তী হয়ে আমরা বিশেষ বিশেষ বস্তুর প্রতি মনোযোগ দিয়ে থাকি । যার সকালে চা খাওয়ার অভ্যাস আছে সে ঘুম থেকে উঠেই চায়ের প্রতি মনোযোগ দেয় ।
অভিজ্ঞতা ( Experience ) :
পূর্ব অভিজ্ঞতা আমাদের মনোযোগ নির্ধারণে সহয়তা করে । নাবিক তার পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে সমুদ্রের কোনো স্থানটিতে গেলে বিপদ হতে পারে তা জানে এবং সেই স্থানটির প্রতি সবসময় মনোযোগ দেয় ।
জীবনাদর্শ ( Philosophy of Life ) :
ব্যক্তি তার জীবনাদর্শের দ্বারা বস্তু বা বিষয়ের প্রতি মনোযোগ দিয়ে থাকে । কেউ দুস্থ ব্যক্তিদের প্রতি সহানুভূতিশীল তাদের দুঃখ মোচনের জন্য মনোযোগী হয় আবার কেউ বা হয় না ।
মনোভাব ( Attitude ) :
মনোভাব মনোযোগের একটি অন্যতম নির্ধারক । যেসব বিষয় বা ঘটনার প্রতি আমাদের ইতিবাচক মনোভাব থাকে সেই সকল বিষয়ের প্রতি আমরা সহজেই মনোযোগী হয়ে পরি ।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় বস্তুগত , ব্যক্তিগত উভয় প্রকার নির্ধারকই সম্মিলিত ভাবে আমাদের মনোযোগের বস্তু নির্বাচনে সহায়তা করে থাকে ।