শিক্ষা বিজ্ঞান

পরিণমন কাকে বলে

Contents

পরিণমন কাকে বলে | পরিণমনের বৈশিষ্ট্য |শিখন ও পরিনমনের মধ্যে সম্পর্ক

পরিণমণ বলতে আমরা সেই আচরণ পরিবর্তনের প্রক্রিয়াকে বুঝি যা পূর্ব অভিজ্ঞতা ভিত্তিক নয় এবং যে আচরণ সম্পাদনের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণলব্ধ অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো হয় না । 

মনোবিদ কোলেসনিক ( Kolesnik ) বলেছেন , “ সহজাত প্রবণতা স্বাভাবিক বিকাশের ফলে আচরণের গুণগত ও পরিমাণগত পরিবর্তনের প্রক্রিয়া বা জন্মগত সম্ভাবনাগুলির বাস্তবায়িত হওয়ার প্রক্রিয়াই হল পরিণমন । ” ( Maturation refers to the changes quantitative or qualitative which result from the natural unfolding of inherited tendencies or actualization of innate potentialities . ) 

মনোবিদ ম্যাকগিয়ক ( McGeoch ) বলেছেন , জৈবিক বিকাশের ফলে বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণ ছাড়াই আচরণ ধারার যে পরিবর্তন হয় তা হল পরিণমন । ” Maturation means changes in behaviour with age which primarily depend upon organic factors rather than upon prior practice and experience . ” ) 

মনোবিদ স্কিনার ( Skinner ) বলেছেন , “ পরিণমন হল এক ধরনের বিকাশ যা পরিবেশগত অবস্থার ব্যাপক তারতম্য সত্ত্বেও মোটামুটি নিয়মিতভাবে সংঘটিত হয় । ” ( Maturaton is development that will preceed fairly regularly even in the face of wide variations in environmental conditions . ” ) বিশেষ বয়ঃপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে শিশুর পেশির সংগঠন ও স্নায়বিক বিকাশ একটি স্বাভাবিক স্তরে পৌঁছলে সে হাঁটতে পারে । একেই আমরা বলি পরিণমনের ফল । 

পরিণমনের বৈশিষ্ট্য  

পরিণমনের এই সংজ্ঞাগুলি থেকে আমরা এই প্রক্রিয়ার নিজস্ব কতগুলি বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করতে পারি । 

বিকাশের প্রক্রিয়া : 

পরিণমন কোনো বিশেষ আচরণ নয় । শিশুর হাঁটতে পারা তার আচরণ বা তার পরিণমনের ফল অর্থাৎ পরিণমন কোনো কাজের দক্ষতা নয় , পরিণমন এক ধরনের প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে ব্যক্তির মধ্যে আচরণগত পরিবর্তন আসে বা নতুন কর্মদক্ষতা সৃষ্টি করে । 

স্বাভাবিক প্রক্রিয়া :

পরিণমনের জন্য অতীত অভিজ্ঞতা বা প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয় না । তাই এটি বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই সংঘটিত হয় । তাই মনোবিদগণ একে স্বাভাবিক বিকাশের প্রক্রিয়া হিসাবে বিবেচনা করেন । 

পরিণমন জৈবিক বিকাশ : 

মনোবিদ বানার্ড বলেছেন , “ Maturation is biological ” অর্থাৎ , পরিণমন মূলত ব্যক্তির জীবধর্মের ওপর নির্ভরশীল । দেহের জৈবিক কেন্দ্রগুলি স্বাভাবিক বিকাশের ওপর নির্ভরশীল । ব্যক্তির জৈবিক কেন্দ্রের বিকাশে কোনো ত্রুটি থাকলে তার পরিমাণলব্ধ আচরণও ত্রুটিপূর্ণ হয় । 

অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া :

পরিণমন সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া । বাহ্যিক পরিবেশের উপাদানের দ্বারা প্রভাবিত নয় ।

নতুন চাহিদার সৃষ্টিকারী প্রক্রিয়া : 

পরিণমন প্রক্রিয়ায় শক্তি ব্যক্তির চাহিদা দ্বারা নির্ধারিত হয় না । তবে পরিণমন প্রক্রিয়ার প্রভাবে ব্যক্তির মধ্যে যে পরিণমন আসে তা নতুন চাহিদা সৃষ্টি করতে পারে ।

দৈহিক ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া : 

পরিণমনের ফলে দেহে সঞ্চালনগত পরিবর্তন হয়ে থাকে । অর্থাৎ , পরিণমন মূলত বৃদ্ধির মাধ্যমে ব্যক্তিকে দৈহিক ক্ষমতা অর্জনে সহায়তা করে । 

সর্বজনীন : 

প্রতিটি ব্যক্তির ক্ষেত্রে পরিণমন প্রায় সমান । অর্থাৎ , প্রতিটি বয়ঃস্তরে প্রতিটি ব্যক্তির প্রায় একই রকমেরই পরিণমন ঘটতে দেখা যায় । সব প্রাণীর ক্ষেত্রে পরিণমন প্রক্রিয়া সংঘটিত হয়ে থাকে । 

নির্দিষ্ট বয়ঃসীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ : 

পরিণমন একটি নির্দিষ্ট বয়ঃসীমার মধ্যে হয়ে থাকে । অর্থাৎ , মাতৃগর্ভে ভ্রূণ সঞ্চারের সময়ে আরম্ভ হয়ে একটি নির্দিষ্ট সময়ে পরিণমনের কাজ বন্ধ হয়ে যায় । ফলে এই প্রক্রিয়াটি ব্যক্তির জীবনে নির্দিষ্ট বয়ঃসীমা পর্যন্ত সক্রিয় থাকে । 

সুতরাং , পরিণমনের এই বৈশিষ্ট্যগুলি থেকে লক্ষ করা যাচ্ছে , এটি জীবন বিকাশের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া । বাইরের কোনো প্রভাব ছাড়াই এই প্রক্রিয়া সংগঠিত হয়ে থাকে । এটি স্বাভাবিকভাবে ব্যক্তির জীবনে আরম্ভ হয় এবং একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ব্যক্তির অজ্ঞাতসারে চলতে থাকে । ব্যক্তি এই প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে সচেতন থাকে না কিন্তু এর ফল সম্পর্কে সচেতন । পরিণমনের ফলে ব্যক্তির মধ্যে শারীরিক পরিবর্তন দেখা যায় , যা ব্যক্তিকে শিখনের জন্য প্রস্তুত করে তোলে ।

শিখন ও পরিনমনের মধ্যে সম্পর্ক

পরিণমন হল এমন একটি জন্মগত প্রবণতা যা স্বাভাবিকভাবে পরিস্ফুট হওয়ার ফলে শিশুর আচরণের পরিণামগত ও গুণগত পরিবর্তন ঘটে । পরিণমন হল শিখন প্রস্তুতির সহায়ক উপাদান । পরিণমন শিশুর শিখনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে । শিখনে পরিণমনের ভূমিকা হল নিম্নরূপ :

শিখনের গতি ও সীমা নির্ধারণ : 

মাতৃগর্ভে ভ্রুণ সঞ্চার থেকে শিশুর পরিণমন ঘটতে থাকে । নির্দিষ্ট পরিণমনের পর শিশুর শিখন শুরু হয় এবং তা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চলতে থাকে । পরিণমনই ঠিক করতে পারে কোন্ সময়ে কোন ধরনের শিখন সার্থক হবে । 

জ্ঞানেন্দ্রিয় ও কর্মেন্দ্রিয়ের সমন্বয় : 

শিক্ষার্থীর সার্থক বিকাশ নির্ভর করে জ্ঞানেন্দ্রিয় ও কর্মেন্দ্রিয়ের সমন্বয়ের ওপর । পরিণমন সার্থকভাবে উভয়ের মধ্যে সমন্বয় ঘটায় । যা শিক্ষার্থীকে যে কোনো বিষয় শিখতে বিশেষভাবে সাহায্য করে । 

শিখন ত্বরান্বিতকরণ : 

পরিণমন শিখনকে ত্বরান্বিত করে । অর্থাৎ , শিক্ষার্থীর উপযুক্ত পরিণমন ঘটলে যে কোনো বিষয় তারা অতি দ্রুত আয়ত্ত করতে পারবে । 

ভাষার বিকাশ বা বাচনিক বিকাশ :

শিশুর ভাষার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে পরিণমন । পরিণমন ছাড়া শিশুর ভাষার বিকাশ সম্ভব নয় । 

পরিকল্পনা মাফিক শিক্ষাদান :

পরিণমনের ওপর নির্ভর করে শিক্ষা পরিকল্পনা । বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সংগতি রেখে শিশুর শিক্ষার জন্য পরিকল্পনা তৈরি করা হয় এবং সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী শিক্ষার্থীকে শিক্ষাদান করা হয় । 

শিখন প্রচেষ্টার কার্যকারিতা :

পরিণমন শিখন প্রচেষ্টাকে কার্যকারী করে তুলতে সাহায্য করে । 

উন্নত ও জটিল আচরণ সম্পাদন : 

উন্নত ও জটিল আচরণগত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীকে অনেক বেশি সক্রিয় করে তোলে । ফলে শিক্ষার্থী যে কোনো জটিল সমস্যার সমাধান সহজে করতে পারে । 

তবে বলা যায় , পরিণমনের সঙ্গে শিখনের একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বর্তমান । শিশু কেবলমাত্র পরিণমনের দ্বারা সব ধরনের ক্ষমতা অর্জন করতে পারে না । তার জন্য শিখনের একান্ত প্রয়োজন । আবার পরিণমনের বিভিন্ন স্তর অনুযায়ী শিক্ষাদানের ব্যবস্থা না করলে শিশুর শিখন ফলপ্রসূ হবে না ।

error: Content is protected !!