শিক্ষা বিজ্ঞান

কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার সমস্যা 

Contents

কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার সমস্যা 

আমাদের দেশে স্বাধীনতার পর দ্রুত শিল্প প্রসারের লক্ষ্যে বৃত্তিমুখী ও কারিগরি শিক্ষার বিকাশ ঘটলেও সমস্যাও অনেক আছে । বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা নীচে আলোচনা করা হল :

পরিকল্পনার অভাব 

ভারতে বৃত্তিমূলক এবং কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অপরিকল্পিত ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে । বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে কী পরিমাণ দক্ষ শ্রমিক বা কারিগর প্রয়োজন তার সঙ্গে সংগতি রেখে প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা উচিত । কিন্তু এ বিষয়ে সঠিক পরিকল্পনার অভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে যে পরিমাণ ইনস্ট্রাকটর , ডিপ্লোমাধারী , এমনকি ডিগ্রিধারী শিক্ষার্থী প্রতি বছর উৎপন্ন হচ্ছে তাদের সকলের চাকরির সুযোগ নেই । আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রয়োজনের তুলনায় কম সংখ্যায় কারিগর তৈরি হওয়ায় সে ক্ষেত্রে চাহিদা থেকেই যাচ্ছে । 

সংযোগের অভাব 

বৃত্তিমুখী ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই শিল্প মহলের সরাসরি সংযোগ না থাকায় কী ধরনের প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিক্ষার্থী শিল্পের জন্য প্রয়োজন তা জানা সম্ভব হয় না । ফলে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হলেও চাকরির জগতে অনেকেই ব্রাত্য থেকে যায় । 

সুষ্ঠু পরিচালনার অভাব 

ভারতে এ যাবৎ বহু সংখ্যক বৃত্তিমূলক এবং কারিগরি শিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও , পরিচালন ব্যবস্থা বা প্রশাসনিক ত্রুটির ফলে তারা বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় ভুগছে । যেমন — যোগ্যতা সম্পন্ন শিক্ষকের অভাব , রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ইত্যাদি । 

উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব 

বর্তমানে উচ্চ বেতন এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধার আশায় বৃত্তিমূলক বা কারিগরি বিদ্যায় উচ্চশিক্ষিত ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষকতা বা প্রশিক্ষণ দানের কাজে যুক্ত না থেকে , বৃহৎ কলকারখানা বা শিল্প প্রতিষ্ঠানে যোগদান করছে । ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি উপযুক্ত প্রশিক্ষক বা শিক্ষকের অভাবে ভুগছে । উপযুক্ত শিক্ষকের অভাবে বৃত্তিমুখী ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদান ব্যাহত হচ্ছে । 

অর্থাভাব 

বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে তত্ত্বগত জ্ঞানের সঙ্গে প্রয়োজন বিভিন্ন যন্ত্রপাতির ব্যাবহারিক জ্ঞান । এর জন্য দরকার উন্নত মানের ওয়ার্কশপ ও উপযুক্ত মানের ল্যাবরেটরি । কিন্তু আজকের দিনে আমাদের দেশের বহু কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপযুক্তমানের যন্ত্রপাতি নেই । অর্থের অভাবে ওইসব যন্ত্রপাতি নিয়ে ওয়ার্কশপের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না । ফলে শিক্ষার্থীরা তত্ত্বমূলক জ্ঞান পেলেও ব্যাবহারিক জ্ঞানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে । এটি এই শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা । 

আধুনিকীকরণের অভাব 

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আবিষ্কৃত হয়েছে ত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি । বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেখানে উন্নতমানের যন্ত্রপাতি দিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে , সেখানে আমাদের দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পুরোনো আমলের যন্ত্রপাতির মাধ্যমে কাজ করা হচ্ছে । ফলে বিশ্বায়নের যুগে এইসব প্রতিষ্ঠান থেকে উত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রীরা অন্যান্য উন্নত দেশের কাছে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে । 

কর্মরত শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অভাব 

আমাদের দেশে বিভিন্ন বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাঁরা শিক্ষকতা করেন বা প্রশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত আছেন তাঁদের জন্য বৃত্তিকালীন প্রশিক্ষণের বিশেষ ব্যবস্থা নেই । বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যেসব নতুন নতুন চিন্তা ভাবনা আসছে — সে সম্পর্কে তাঁরা ছাত্রছাত্রীদের কিছুই জানাতে পারছেন না । ফলে ওইসব প্রতিষ্ঠানে বৃত্তিমুখী বা কারিগরি শিক্ষার নিম্নমানের জন্য শিক্ষার্থীরা ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে । 

ভাষা সমস্যা 

বৃত্তিমুখী ও কারিগরি শিক্ষায় একটি বড়ো অন্তরায় হল ভাষা সমস্যা । আমাদের দেশের বেশিরভাগ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীরা মাতৃভাষার মাধ্যমে পড়াশোনা করে , কিন্তু বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার বইপত্র ইংরেজি ভাষায় লেখা । শিক্ষার্থীদের তা বুঝতে অসুবিধা হয় । যদিও কোঠারি কমিশনে আঞ্চলিক বা মাতৃভাষার মাধ্যমে পলিটেকনিক ও ডিপ্লোমা স্তরের শিক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে তবুও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আঞ্চলিক বা মাতৃভাষায় বৃত্তিমূলক কারিগরি শিক্ষার পাঠ্যপুস্তক রচিত হয়নি । 

স্বাধীনতার পর আমাদের দেশে বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার দ্রুত অগ্রগতি ঘটলেও নানান কারণে আজও এই শিক্ষা সমস্যা জর্জরিত । অর্থাভাব , উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব , শিল্পমহলের সঙ্গে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যোগাযোগের অভাব , ভাষাগত সমস্যা , পাঠ্যপুস্তকের অভাব , উন্নত প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতির অভাব ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে এই ধরনের শিক্ষার সম্পূর্ণ সুফল থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি । এইসব সমস্যার সমাধান করতে না পারলে । ভবিষ্যতে এই শিক্ষা ব্যবস্থায় আমরা পিছিয়ে থাকব ।

error: Content is protected !!