শিক্ষা বিজ্ঞান

ভারতে মূক ও বধির শিশুদের শিক্ষার বর্তমান অবস্থা 

ভারতে মূক ও বধির শিশুদের শিক্ষার বর্তমান অবস্থা 

পৃথিবীর উন্নত দেশগুলিতে মূক ও বধির ছেলেমেয়েদের শিক্ষা নিয়ে যতটা কাজ হয়েছে , আমাদের দেশে সেই তুলনায় কাজ হয়েছে খুব কম । প্রথম দিকে এখানে মূক ও বধির ছেলেমেয়েদের জন্য শিক্ষা শুরু হয় মূলত মানবতা ও দাতব্যের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে । বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনগুলি এ বিষয়ে অগ্রণীর ভূমিকা নেয় । ধীরে ধীরে সামাজিক দায়বদ্ধতা ও শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয় । 

পরবর্তীকালে সরকারি ভাবেও সাহায্যের ব্যবস্থা করা হয় । ভারতে সর্বপ্রথম ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে বোম্বাইয়ে ( বর্তমানে মুম্বাইয়ে ) মূক ও বধির ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয় । পশ্চিমবঙ্গে ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় মূক ও বধিরদের জন্য বিদ্যালয় স্থাপন করা হয় । পরবর্তীকালে কলকাতায় মূক ও বধিরদের জন্য আরও কয়েকটি বিদ্যালয় গড়ে তোলা হয় । 

ভারতে মূক ও বধিরদের সংখ্যা ঠিক কত সে বিষয়ে যথাযথ তথ্য সংগ্রহের খুব একটা চেষ্টা হয়নি । সরকারি ও বেসরকারি তথ্যের মধ্যে বহু গরমিল রয়েছে । বেসরকারি সংস্থার মতে মূক ও বধিরদের সংখ্যা সরকারি হিসাবের তুলনায় অনেক বেশি । কোঠারি কমিশন ( ১৯৬৪-৬৬ ) শারীরিক প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েদের সংখ্যা নির্ণয়ে সরকারি ভাবে পদক্ষেপ নেয় । এরপর ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব এডুকেশন এর পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয় । 

এই দুই সংস্থার পক্ষ থেকে যেসব তথ্য সংগৃহীত হয় তার ভিত্তিতে অনুমান করা হয় যে , ভারতে ৫ থেকে ১৪ বছর বয়সের প্রায় ১ কোটি ২৫ লক্ষ ছেলেমেয়ে কমবেশি বধিরতা জনিত ত্রুটিতে ভুগছে । ২০ লক্ষেরও বেশি মানুষ মূক ও বধির । এইসব মানুষের মধ্যে ‘ বিদ্যালয়ে যাওয়ার উপযোগী ‘ ছেলেমেয়ের সংখ্যা প্রায় চার লক্ষ । কিন্তু আমাদের দেশে মূক ও বধির ছেলেমেয়েদের জন্য বিদ্যালয়ের সংখ্যা মাত্র ২৭০ টি । পশ্চিমবঙ্গে মূক-বধিরদের জন্য বিদ্যালয়ের সংখ্যা মাত্র ১৫ টি । 

পরিসংখ্যান থেকে বলা যায় যে , মূক ও বধির ছেলেমেয়েদের মধ্যে মাত্র ১ % শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে । বর্তমানে প্রতিটি রাজ্যে এদের জন্য কমপক্ষে একটি করে সরকারি বিদ্যালয় রয়েছে । অন্যগুলি সাহায্য প্রাপ্ত বেসরকারি বিদ্যালয় । ভারতে মূক ও বধির ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য মাত্র ছয়টি শিক্ষক শিক্ষণ প্রতিষ্ঠান রয়েছে । এইসব বিদ্যালয়ে এক বছরের জন্য শিক্ষক শিক্ষণের ব্যবস্থা হয় । বছরে সত্তর জন শিক্ষক এখান থেকে প্রশিক্ষণ পেতে পারেন । আমেদাবাদ , দিল্লি , লক্ষ্ণৌ , কলকাতা , অন্ত্র ও মাদ্রাজে শিক্ষক শিক্ষণের বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে । 

আমাদের রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ মূক ও বধির বিদ্যালয়টি হল Calcutta Deaf and Dumb School | এখানে চার থেকে বারো বছরের মূক ও বধির ছেলেমেয়েদের ভরতি করা হয় । এখানে প্রথম চার বছরে যে চারটি শ্রেণি পড়ানো হয় তা হল প্রিপারেটরি – I , প্রিপারেটরি- II , জুনিয়র – I এবং জুনিয়র- II । এই পর্যায়গুলিতে কীভাবে কথা বলা যায় তা শেখানো হয় । এরপর যে চারটি শ্রেণিতে পড়ানো হয় তা হল – জুনিয়র- III , সিনিয়র – I , সিনিয়র- II এবং সিনিয়র- III । এই বিদ্যালয় ‘ ডিরেকটরেট অব টেকনিক্যাল এডুকেশন ’ এর নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয় ।

মূক ও বধিরদের শিক্ষার সুব্যবস্থা 

মূক ও বধির ছেলেমেয়েদের শিক্ষার বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় — এখনও আমাদের দেশে এই শিক্ষা ব্যবস্থা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য । এই অবস্থায় এইসব ছেলেমেয়েদের শিক্ষার সুব্যবস্থা করতে হলে যেসব কাজ অবিলম্বে করতে হবে তা হল : 

[ 1 ] সারা দেশে মূক ও বধির ছেলেমেয়ের সংখ্যা বর্তমানে ঠিক কত তা সঠিকভাবে নির্ণয় করতে হবে । 

[ 2 ] মোট মূক ও বধির ছেলেমেয়েদের জন্য উপযুক্ত সংখ্যায় বিদ্যালয় বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে । 

[ 3 ] মূক ও বধির ছেলেমেয়েদের শিক্ষার সমস্ত খরচ কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারকে বহন করতে হবে । 

[ 4 ] মূক ও বধির ছেলেমেয়েদের পড়ানোর জন্য উপযুক্ত শিক্ষক শিক্ষিকার ব্যবস্থা করতে হবে । শিক্ষক শিক্ষণের সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে । 

[ 5 ] এই মুহূর্তে যদি যথেষ্ট সংখ্যক মূক ও বধির বিদ্যালয় স্থাপন সম্ভব না হয় , তা হলে সাধারণ বিদ্যালয়গুলিতে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিক্ষকের দ্বারা মূক-বধির ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে । 

[ 6 ] সর্বোপরি , মূক ও বধির ছেলেমেয়েদের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তুলতে হবে , অত্যন্ত ধৈর্য সহকারে সহানুভূতির সঙ্গে তাদের পড়াতে হবে এবং শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় আধুনিক শিক্ষামূলক উপকরণ ও প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে ।

error: Content is protected !!