বুনিয়াদি শিক্ষা বা নঈ তালিম কাকে বলে
Contents
বুনিয়াদি শিক্ষা বা নঈ তালিম কাকে বলে
১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে সেবাগ্রামে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে বুনিয়াদি শিক্ষাকে ‘ জীবনের জন্য শিক্ষা ’ বলে অভিহিত করা হয় । মনে করা হয় , এই শিক্ষা ব্যবস্থা সামাজিক , অর্থনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে ভারতীয় সমাজকে এক নতুন পথের সন্ধান দেবে । এই সময় থেকে গান্ধীজি ‘ বুনিয়াদি শিক্ষা’কে ‘ নঈ তালিম ‘ হিসেবে গণ্য করেন ।
বুনিয়াদি বা নঈ তালিম শিক্ষার গুণাবলী
সক্রিয়তা ভিত্তিক শিক্ষা :
গান্ধীজির নঈ তালিম শিক্ষা ব্যবস্থাটি সক্রিয়তার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠায় শিক্ষার্থীরা খুব সহজেই এই শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছিল ।
সামাজিক গুণের বিকাশ :
এই শিক্ষায় শিক্ষার্থীরা দলগতভাবে অংশ নেওয়ার ফলে তাদের মধ্যে সহযোগিতা , সহমর্মিতা , সমবেদনা প্রভৃতি সামাজিক গুণের বিকাশ ঘটে , যা শিক্ষার্থীকে ভাবী জীবনে আরও বেশি সামাজিক হতে সাহায্য করে ।
শ্রমের প্রতি মর্যাদা :
এই শিক্ষায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা নিজেরা কায়িকশ্রমে অংশ নেয় । ফলে তাদের মধ্যে শ্রমের প্রতি মর্যাদাবোধ গড়ে ওঠে ।
নৈতিক গুণাবলির বিকাশ :
নঈ তালিম শিক্ষা ব্যবস্থায় গান্ধীজি পাঠক্রমকে সত্য এবং ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । শিক্ষার্থীরা সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে কর্মভিত্তিক শিক্ষায় অংশ নেওয়ার ফলে তাদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটে ।
চাহিদা ও আগ্রহ ভিত্তিক শিক্ষা :
নঈ তালিম শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হত । এখানে শিক্ষার্থীরা নিজস্ব চাহিদা , প্রবণতা , ক্ষমতা এবং আগ্রহ অনুযায়ী শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পেত ।
বৃত্তিমুখী শিক্ষা :
এই শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীরা কোনো একটি বৃত্তিকে কেন্দ্র করে সেই বিষয়ে শিক্ষা লাভ করত । ফলে অল্প বয়স থেকেই তাদের মধ্যে বৃত্তি সম্বন্ধে ধারণা গড়ে উঠত ।
শরীর চর্চা :
এই শিক্ষায় দৈহিক শ্রমের বিনিময়ে শিক্ষা লাভ করার সময় শিক্ষার্থীদের কিছুটা শরীরচর্চাও হয়ে যেত । তা ছাড়া শিক্ষার অঙ্গ হিসেবে পাঠক্রমে শারীর চর্চাকেও স্থান দেওয়া হত ।
সৃজনশীলতার বিকাশ :
উৎপাদন ভিত্তিক এবং শিল্পকেন্দ্রিক বৃত্তিমূলক শিক্ষায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিভিন্ন কাজ করতে করতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নানা ধরনের সৃজনশীল ক্ষমতার বিকাশ ঘটত ।
বাস্তব অভিজ্ঞতা :
নঈ তালিম বা বুনিয়াদি শিক্ষায় শিক্ষার্থী নিজের মাথা ( Head ) , হাত ( Hand ) এবং হৃদয় ( Heart ) — এই তিনটিকে একসঙ্গে কাজে লাগানোর সুযোগ পেত । ফলে তাদের মধ্যে খুব সহজেই বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জিত হত ।
কর্মজগতে প্রবেশ :
নঈ তালিমে শিক্ষা লাভের পর শিক্ষার্থীরা যে অভিজ্ঞতা লাভ করত তাকে কাজে লাগিয়ে তারা বিভিন্ন ধরনের কর্মজগতে অনেক সহজে প্রবেশ করতে পারত ।
নিজস্ব সংস্কৃতিজাত শিক্ষা :
ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ভিত্তি করেই এই শিক্ষা পরিকল্পিত হয় । ফলে নিজ সংস্কৃতির প্রতি মর্যাদা এবং জাতীয়তাবাদ বিকাশে এই শিক্ষা ছিল আদর্শ ।
অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা :
এই শিক্ষা গ্রাম ভিত্তিক কোনো শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠায় গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী হত এবং স্বনির্ভরতা অর্জনে সহায়ক হত ।
বুনিয়াদি বা নঈ তালিম শিক্ষার ত্রুটি
অভিজ্ঞ শিক্ষকের অভাব :
বুনিয়াদি বা নঈ তালিম শিক্ষা পরিচালনার জন্য যে ধরনের অভিজ্ঞ শিক্ষকের প্রয়োজন হত তার যথেষ্ট অভাব ছিল । শিক্ষকের অভাবে এই ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা দীর্ঘস্থায়ী করা সম্ভব হয়নি ।
সাংগঠনিক ত্রুটি :
বুনিয়াদি বা নঈ তালিম শিক্ষা লাভের পর উচ্চতর শিক্ষার পর্যায় কেমন হবে তার সঠিক নির্দেশ না পাওয়ায় বহু শিক্ষার্থী এই ধরনের শিক্ষায় অনীহা প্রকাশ করে ।
শিল্পের প্রতি অতি সক্রিয়তা :
এই শিক্ষা যেহেতু একটি শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠত , তাই ওই বিষয়ে অধিক সক্রিয় হয়ে কাজ করতে করতে শিক্ষার্থীরা অন্যান্য বিষয়ে খুব একটা নজর দিতে পারত না । ফলে অন্যান্য বিষয়ে জ্ঞানার্জন অবহেলিত হত ।
উৎপাদনমুখীতা :
এই প্রকার শিক্ষায় শিক্ষার্থীরা উৎপাদনের দিকে নজর দিয়ে অর্থ উপার্জনের প্রতি অধিক আগ্রহী হয়ে পড়ত । ফলে অভিজ্ঞতা অর্জন ও অন্যান্য গুণের বিকাশ ব্যাহত হত ।
অনুবন্ধ নীতি প্রয়োগে অসুবিধা :
বুনিয়াদি বা নঈ তালিম শিক্ষা ব্যবস্থায় অনুবন্ধ নীতি অনুসরণের কথা বলা হলেও বাস্তবে তা সঠিকভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হয় না ।
গ্রাম ভিত্তিক শিক্ষা :
বুনিয়াদি বা নঈ তালিম শিক্ষা মূলত একটি গ্রামকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা হয়েছিল । শহরের শিক্ষার্থীদের জন্য তেমন কোনো শিল্প নির্বাচনের বিষয় না থাকায় শহরাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা এই শিক্ষায় অনীহা প্রকাশ করে ।
আর্থিক স্বনির্ভরতা :
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত সামগ্রী বাজারে বিক্রি করে উপার্জিত অর্থের দ্বারা শিক্ষার ব্যয় নির্বাহ করা বাস্তব সম্মত নয় । অনেকে সমালোচনা করে বলেন যে , এই শিক্ষা ব্যবস্থায় আর্থিক দিকের প্রতি বেশি জোর দেওয়া হয়েছে । শিক্ষার সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক দিকটা অবহেলিত হয়েছে ।