ইতিহাস

ভারতে রেলপথ স্থাপনের ক্ষতিকর দিক

Contents

ভারতে রেলপথ স্থাপনের ক্ষতিকর দিক

উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে রেলপথ ভারতীয় অর্থনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করলেও ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অনেকেই রেল পরিবহনকে ভালাে চোখে দেখেননি । দাদাভাই নওরােজি , রমেশ চন্দ্র দত্ত , বালগঙ্গাধর তিলক , জি. ভি. যােশি , জি. এস. আয়ার প্রমুখের মতে রেলপথ ব্রিটিশের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থপূরণ করলেও ভারতীয়দের কোনাে উপকারে আসেনি । ঐতিহাসিক উইলিয়াম জেনিংসন ব্রায়ানের  মতে — ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ভারতীয়দের উন্নতির জন্য নয় শুধুমাত্র ব্রিটিশ জাতির স্বার্থে রেলপথ ও সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল ।

british railway
British Time Indian Railway

ভারতে রেলপথের বিস্তার ভারতবাসীকে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলেছিল । সেগুলি হল —

ভারতীয় পণ্যের ধ্বংস প্রাপ্তি

রেলপথ স্থাপনের ফলে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল ও বন্দরের মধ্যে যােগাযােগ গড়ে উঠলে বিদেশি শিল্পপণ্য সহজেই সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে যায় । বিদেশি পণ্য দেশীয় পণ্যের তুলনায় সস্তা ও সহজলভ্য ছিল । এই অসম বাণিজ্যিক প্রতিযােগিতার ফলে ভারতের শিল্প ও বাণিজ্য ধ্বংসের মুখে চলে গিয়েছিল ।

সম্পদের নিষ্কাশন

রেলপথ স্থাপন ভারত থেকে সম্পদের নিষ্কাশন বৃদ্ধি করেছিল । ভারতীয় সম্পদ প্রচুর পরিমাণে বিদেশে চলে যেতে থাকে । অপরদিকে বিদেশি পণ্য ভারতীয় বাজারে ঢুকে পড়লে ভারতের গ্রাম , শহর ও কৃষি খামার বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে ।

অন্যান্য যোগাযােগ ব্যবস্থার অবনমন

রেলপথের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়ার ফলে জলপথ অবহেলিত হয়ে পড়ে । রক্ষণা বেক্ষণের অভাবে নদীর নাব্যতা নষ্ট হয় এবং জলসেচ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে । জাতীয়তাবাদী লেখকদের মতে , এই রকম অবহেলা না করে সরকার জলসেচ ও পরিবহনের ওপর গুরুত্ব আরােপ করলে দুর্ভিক্ষ মােকাবিলা সহজ হত এবং সমস্যা এত জটিল হয়ে উঠত না । কারণ ১৯০২ – ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে জলসেচের উন্নতির জন্য খরচ হয় ৪৩ কোটি টাকা । কিন্তু ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রেলপথ নির্মাণে খরচ হয়েছিল ৩৫৯ কোটি টাকা।

অতিরিক্ত করারোপ

লর্ড ডালহৌসি ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় রেলপথ নির্মাণের ব্যয় হিসাব করে মাইল প্রতি  ৮০০০ পাউন্ড খরচ হবে বলে মনে করেন । কিন্তু তার জায়গায় ভারতে মাইল প্রতি রেলপথ নির্মাণে ব্যয় হয় ১৮  হাজার পাউন্ড । এই বাড়তি ব্যয়ভার বহন করতে হয়েছিল সাধারণ ভারতবাসীকে । ভারতবাসী প্রচুর করভাবে জর্জরিত হয়ে পড়ে ।

খাদ্য শস্যের অভাব

রেলপথ স্থাপনের ফলে ভারত থেকে চাল , গম ইত্যাদি শস্য এত বিপুল পরিমাণে ইংল্যান্ডে রপ্তানি হয়ে যায় যে তার ফলে ভারতে খাদ্য শস্যের অভাব সৃষ্টি হয় । যার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতে ঘনঘন দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় ।

উপসংহার

রেলপথের স্থাপন দেশীয় সম্পদ শােষণের পথকে প্রশস্ত করে , এর পাশাপাশি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার ভিতকে মজবুত করে । স্বয়ং সম্পূর্ণ স্বনির্ভরশীল গ্রামগুলি রেলপথের কবলে পড়ে হত দরিদ্র হয়ে যায় । এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক ডি. এইচ. বুকানন  বলেছেন — স্বনির্ভরতার লৌহবর্ম ভারতবর্ষের গ্রামগুলিকে রক্ষা করে আসছিল , ইস্পাতের রেল সেই লৌহবর্ম ভেদ করে গ্রাম্য জীবনের রক্ত শােষণ শুরু করে দেয় । 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!