স্থানীয় স্বায়ত্ত শাসন সম্পর্কিত ৭৩ তম ও ৭৪ তম সংবিধান সংশোধনী 

Contents

স্থানীয় স্বায়ত্ত শাসন সম্পর্কিত ৭৩ তম ও ৭৪ তম সংবিধান সংশোধনী 

গণতন্ত্রের একটি অপরিহার্য অঙ্গ হল স্থানীয় স্বায়ত্ত শাসন ব্যবস্থা । স্থানীয় স্বায়ত্ত শাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে জনগণ সরকারি কাজকর্ম পরিচালনায় সক্রিয় অংশ গ্রহণ করে গণতন্ত্রকে আরও অর্থবহ ও ফলপ্রসূ করে তোলে । 

জনপ্রশাসনবিদ ড. কে. কে. পিল্লাইয়ের মতে , জাতীয় রাষ্ট্রের গণতন্ত্রের একটি শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হল স্থানীয় স্বায়ত্ত শাসন । এ হল গ্রামীণ ও পুর এলাকার এমন এক স্থানীয় সরকার যা জনগণের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সংযোগ রক্ষা করে চলে ( ” Local Self – Government is the best school of national democracy . It is the local Government of the village or the municipality that touches most intimately the lives of the people ” ) । 

গণতন্ত্রের সাফল্যের একটি প্রধান শর্ত হল ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ( Decentralization of Power ) । স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে এই শর্ত বাস্তবে আরও দৃঢ়ভাবে রূপায়িত হয় । 

সাংবিধানিক স্বীকৃতি 

১৯৯২ সালে ৭৩ তম এবং ৭৪ তম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ভারতের গ্রামীণ ও পুর এলাকায় স্থানীয় স্বায়ত্ত শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের ক্ষেত্রে এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় । ৭৩ তম সংবিধান সংশোধনের ফলে দেশের গ্রামাঞ্চলে ত্রি-স্তর বিশিষ্ট পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু হয় । অন্যদিকে ৭৪ তম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ভারতের শহর এলাকায় পৌরসভা ও পৌরনিগম পত্তনের ব্যবস্থা করা হয় । 

প্রসঙ্গত বলা যায় , ১৯৯২ সালে ৭৩ তম এবং ৭৪ তম সংবিধান সংশোধনের বহু আগে ১৯৭৩ সালে ‘ পশ্চিমবঙ্গ পঞ্চায়েত আইন ’ প্রবর্তনের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গে স্থানীয় স্বায়ত্ত শাসন ব্যবস্থার সূচনা ঘটে । এরপর রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে ১৯৭৮ সালে পশ্চিমবঙ্গে প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচনের মাধ্যমে সারা রাজ্যে গ্রামীণ স্বায়ত্ত শাসন ব্যবস্থার নীতি বাস্তবে রূপায়িত হয় । ৭৩ তম এবং ৭৪ তম সংবিধান সংশোধনীর সঙ্গে সংগতি রেখে ১৯৯২ এবং ১৯৯৩ সালে যথাক্রমে ‘ পশ্চিমবঙ্গ পঞ্চায়েত সংশোধনী আইন ’ ও ‘ পশ্চিমবঙ্গ পৌর আইন ’ কার্যকর হয় । 

৭৩ তম সংবিধান সংশোধনী আইন : গ্রামীণ এলাকা 

1. ভারতের প্রতিটি রাজ্যে গ্রাম স্তরে ও জেলায় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক । 

2. গ্রাম পঞ্চায়েত , পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদসহ ত্রিস্তর পঞ্চায়েত গঠন বাধ্যতামূলক । 

3. পঞ্চায়েত সদস্যরা জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হবেন ।

4. লোকসভা ও বিধানসভার সদস্যরা তাঁদের নির্বাচন কেন্দ্রের অধীনস্থ পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদের সদস্য হিসেবে গণ্য হবেন । রাজ্যসভা ও বিধান পরিষদের সদস্যরাও পদাধিকারবলে জেলা পরিষদের সদস্যরূপে বিবেচিত হবেন । 

5. রাজ্যের আইন অনুসারে গ্রাম পঞ্চায়েতের সভাপতি ( প্রধান ) গ্রামবাসীদের ভোটে নির্বাচিত হবেন , অন্যদিকে পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদের নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে থেকে সংশ্লিষ্ট দুই স্তরের সভাপতিরা নির্বাচিত হবেন । 

6. ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের প্রতিটি স্তরে তপশিলি জাতি ও উপজাতিদের জন্য আসন সংরক্ষিত থাকবে ।

7. ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের প্রতিটি স্তরে তপশিলি জাতি ও উপজাতির মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসনসহ মোট আসনের এক-তৃতীয়াংশ মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে । 

8. প্রতিটি স্তরের পঞ্চায়েতের সাধারণ কার্যকাল হবে পাঁচ বছর । 

9. প্রতিটি রাজ্যের পঞ্চায়েত সেই রাজ্যের আইনের অধীনে থেকে কাজ করবে । 

10. এ ছাড়া এই সংশোধনীতে রয়েছে পঞ্চায়েতের গঠন , ক্ষমতা , কার্যকাল , সদস্যপদের যোগ্যতা-অযোগ্যতা , কর আরোপের পদ্ধতি , পঞ্চায়েত নির্বাচনের জন্য রাজ্য নির্বাচন কমিশন গঠন ইত্যাদি সম্পর্কে বিশদ তথ্য । 

৭৪ তম সংবিধান সংশোধনী আইন : শহর এলাকা 

1. প্রথমত , আধা শহর এলাকায় নগর পঞ্চায়েত ; দ্বিতীয়ত , শহর এলাকায় পৌরসভা ; তৃতীয়ত , বৃহত্তর শহর এলাকায় পৌরনিগম — শহরাঞ্চলে এই তিন ধরনের পৌর স্বায়ত্ত শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে । 

2. পৌরসভার গঠন ও ক্ষমতা সম্পর্কিত নির্দেশ দেওয়া হয়েছে । 

3. পুর এলাকায় তপশিলি জাতি ও উপজাতিদের জন্য আসন সংরক্ষণ করতে হবে । 

4. পুরসভায় মোট আসনের এক-তৃতীয়াংশ ( তপশিলি জাতি ও উপজাতির মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসনসহ ) মহিলাদের জন্য সংরক্ষণ করতে হবে । 

5. পুর নির্বাচন পরিচালনার জন্য রাজ্য নির্বাচন কমিশন গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে । 

6. পুর কর , পুর অনুদান এবং রাজ্য ও পুরসভাগুলির মধ্যে রাজস্ব বণ্টন বিষয়ক নীতি নির্ধারণের জন্য রাজ্য অর্থ কমিশন গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে । 

7. জেলা স্তরে ‘ জেলা পরিকল্পনা কমিটি ’ এবং মহানগরী এলাকায় ‘ মহানগর পরিকল্পনা কমিটি ’ গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে । 

8. প্রতিটি স্তরের পুরসভার পাঁচ বছরের সাধারণ কার্যকাল হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে । 

উপসংহার 

সংবিধানের ৭৩ তম এবং ৭৪ তম সংশোধনী আইন ভারতে স্থানীয় স্বায়ত্ত শাসন ব্যবস্থার ইতিহাসে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করে । পঞ্চায়েত ও পুর ব্যবস্থা এর ফলে সাংবিধানিক স্বীকৃতি লাভ করে । গ্রামীণ উন্নয়ন ও পুনর্গঠনের পাশাপাশি পুর এলাকার উন্নয়ন ও পুনর্গঠনে সর্বস্তরের জনগণের রাজনৈতিক অংশ গ্রহণের আদর্শটি এই সংবিধান সংশোধনের সহায়তায় তত্ত্ব থেকে বাস্তবে রূপায়িত হয় ।

error: Content is protected !!