ভারতের বিপ্লবী আন্দোলনের গুরুত্ব বা তাৎপর্য
ভারতের বিপ্লবী আন্দোলনের গুরুত্ব বা তাৎপর্য
বহু ত্যাগ , তিতিক্ষা , আত্মবিসর্জনের মাধ্যমে মৃত্যুঞ্জয়ী বিপ্লবীরা আপাতভাবে সফলতা না পেলেও সুদূরপ্রসারী প্রভাবের বিচারে বিপ্লবীদের অবদান ব্যর্থ হয়নি । তাই গুরুত্বের বিচারে বিপ্লবী আন্দোলনকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না । অধ্যাপক সুমিত সরকারের মতে — সামগ্রিক বিচারে এটা এড়িয়ে যাওয়া খুবই কঠিন যে বৈপ্লবিক সন্ত্রাসবাদ ছিল একটি বীরােচিত ব্যর্থতা ( ‘ Taken as a whole , it is difficult to avoid the conclusion that revolutionary terrorism was a heroic failure ‘ ) ।

বিপ্লবী আন্দোলনের গুরুত্ব বা তাৎপর্য
বিপ্লবী আন্দোলনের অন্যতম কয়েকটি গুরুত্ব ছিল —
লক্ষ্য — স্বাধীনতা অর্জন :
ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের মূলধারার লক্ষ্য ছিল ভারতের স্বাধীনতা অর্জন । বিপ্লবী আন্দোলনেরও মূল লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা লাভ করা । তাই লক্ষ্যের অভিন্নতা থাকায় বিপ্লবী আন্দোলন জাতীয় আন্দোলনকেই শক্তিশালী করেছিল বলা চলে ।
স্বাধীনতার মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা :
স্বাধীনতা প্রাপ্তি ও স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার যে কি অমূল্য তা বিপ্লবীরা নিজেদের জীবন উৎসর্গের মধ্যে দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন । ভারতবাসীর মনে স্বাধীনতার মূল্যবােধ জাগাতে বিপ্লবীরাও ছিলেন অন্যতম শরিক ।
নতুন রাজনৈতিক আদর্শ স্থাপন :
বিপ্লবীরা ভারতে বিপ্লবের প্রস্তুতি নিতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে ভারতের বাইরে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যােগাযােগ করেছিল । এই যােগাযােগের মধ্যে দিয়েই বিদেশের রাজনৈতিক আদর্শের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল এদেশে । বিপ্লবী এম. এন. রায় রাশিয়ার সঙ্গে যােগাযােগ গড়ে তুলে ভারতে মার্কসবাদী আদর্শের ভিত্তি স্থাপনে সাহায্য করেন ।
সশস্ত্র সংগ্রাম পদ্ধতির উদ্ভাবন :
ভারতে ও ভারতের বাইরে যেভাবে বিপ্লবীরা অস্ত্রশস্ত্রের সাহায্যে স্বাধীনতা সংগ্রামে নিয়ােজিত হয়েছিলেন তাতে জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে এক সশস্ত্র সংগ্রাম পদ্ধতির উদ্ভাবন ঘটেছিল । গুপ্ত হত্যা , অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা , এমনকি সেনবাহিনীকেও প্রভাবিত করার প্রচেষ্টা বিপ্লবীদের সশস্ত্র সংগ্রামেরই পরিচায়ক ।
ব্রিটিশের মনে ত্রাসের সঞ্চার :
বিপ্লবীদের বিপ্লববাদী প্রচেষ্টা এদেশ থেকে ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদের কোনাে সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে না পারলেও ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রে ত্রাসের সঞ্চার সৃষ্টি করতে পেরেছিল । বিপ্লবীদের কার্যকলাপে শাসকবর্গ আত্মরক্ষার জন্য সদা শঙ্কিত ও উদবিগ্ন ছিল ।
বিদেশি শক্তির সাহায্য :
দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য দেশের বাইরে গিয়ে বিভিন্ন বিদেশি শক্তির সাহায্য নিতেও বিপ্লবীরা কুণ্ঠা বােধ করেনি । বিদেশি শক্তির সাহায্য নিয়েও যে স্বাধীনতার জন্য লড়াই চালানাে যায় এই নিদর্শন স্বদেশবাসীর কাছে প্রথম রেখেছিল বিপ্লবীরাই । উদাহরণ হিসেবে বলা যায় , নেতাজি সুভাষচন্দ্র বিদেশি শক্তির সাহায্য নিয়েই ভারতবাসীকে স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন ।
উপসংহার
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস বিভিন্ন ধারা , মত , আদর্শ , পদ্ধতির দ্বারা পরিপুষ্ট ছিল । এই বিভিন্ন মত ও পথের কোনাে একটিকেই আমরা গুরুত্বহীন বলতে পারি না । বিপ্লবীদের আন্দোলনকে বাদ দিলে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস অসম্পূর্ণ থাকবে । নিজ দেশে পরবাসী হয়ে থাকার পরিবর্তে আত্মহত্যা করা ভালাে — মনুষ্যত্বের এই শিক্ষা দিয়ে বিপ্লবীরা আমাদের গর্বিত করেছিল । এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ মুখােপাধ্যায় বলেছেন — তারা আবার আমাদের মনুষ্যত্বের গর্ব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ( ‘ They gave us back the pride of our manhood ‘ ) ।