ভারতের সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা ও কার্যাবলী
Contents
ভারতের সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা ও কার্যাবলী
ভারতের কেন্দ্রীভূত ও অখণ্ড বিচার ব্যবস্থার শীর্ষে রয়েছে সুপ্রিমকোর্ট । এই আদালতকে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত বা যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত বলা হয় । সুপ্রিমকোর্টের কার্যক্ষেত্রকে চার ভাগে ভাগ করা হয়— ( 1 ) মূল এলাকা , ( 2 ) আপিল এলাকা , ( 3 ) পরামর্শদান এলাকা , ( 4 ) নির্দেশ , আদেশ বা লেখ জারির এলাকা ।
মূল এলাকা
সংবিধানের ১৩১ নং ধারা অনুযায়ী , যেসব বিষয়ের মামলা হাইকোর্ট বা অন্য কোনো অধস্তন আদালতে দায়ের করা যায় না সেই বিষয়গুলি সুপ্রিমকোর্টের মূল এলাকার অন্তর্ভুক্ত । আইনগত অধিকারের প্রশ্নে —
1. কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে এক বা একাধিক রাজ্য সরকারের বিরোধ বাধলে ,
2. কেন্দ্রীয় সরকার এবং এক বা একাধিক রাজ্য সরকারের সঙ্গে অন্যান্য কয়েকটি বা একটি রাজ্য সরকারের বিরোধ দেখা দিলে ,
3. দুই ও ততোধিক রাজ্য সরকারের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধ দেখা দিলে একমাত্র সুপ্রিমকোর্ট তার নিষ্পত্তি করার অধিকারী ।
তা ছাড়া রাষ্ট্রপতি কিংবা উপরাষ্ট্রপতির নির্বাচন সংক্রান্ত যে কোনো বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষমতা সুপ্রিমকোর্টের মূল এলাকার অন্তর্ভুক্ত ।
আপিল এলাকা
ভারতের সর্বোচ্চ আপিল আদালত হল সুপ্রিমকোর্ট । আপিল এলাকাকে চার ভাগে ভাগ করা যায় , যেমন— 1. সংবিধানের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত আপিল , 2. দেওয়ানি আপিল , 3. ফৌজদারি আপিল এবং 4. বিশেষ অনুমতি সূত্রে আপিল ।
সংবিধানের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত আপিল
সংবিধানের ১৩২ ( ১ ) নং ধারা অনুসারে দেওয়ানি , ফৌজদারি বা অন্য যে কোনো মামলায় হাইকোর্ট যদি এই মর্মে প্রমাণ পত্র দেয় যে সংশ্লিষ্ট মামলাটির সঙ্গে সংবিধানের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জড়িত , তাহলে ওই মামলার বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টে আপিল করা যায় ।
তা ছাড়া হাইকোর্ট এ ধরনের প্রমাণপত্র না দিলেও সুপ্রিমকোর্ট যদি মনে করে যে মামলাটির সঙ্গে সংবিধানের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জড়িত , তাহলে সুপ্রিমকোর্ট নিজেই মামলাটির বিচারের জন্য আপিলের ‘ বিশেষ অনুমতি ’ ( Special leave to appeal by the Supreme Court ) দিতে পারে [ ১৩৬ ( ১ ) নং ধারা ] ।
দেওয়ানি আপিল
১৯৭২ সালে সংবিধানের ৩০ তম সংশোধনের পর বর্তমানে কোনো দেওয়ানি মামলায় হাইকোর্ট যদি এই মর্মে প্রমাণপত্র দেয় যে সংশ্লিষ্ট মামলাটির সঙ্গে আইনের সাধারণ প্রকৃতির গুরুত্বপূর্ণ কোনো প্রশ্ন জড়িত , তাহলে সেই মামলাটির বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টে আপিল করা যায় । তা ছাড়া সংবিধানের ১৩৩ ( ১ ) নং ধারা অনুসারে হাইকোর্ট যদি মনে করে যে , কোনো দেওয়ানি মামলার বিচার সুপ্রিমকোর্টে হওয়া উচিত তাহলে সেই মামলা নিয়ে সুপ্রিমকোর্টে আপিল করা যায় ।
ফৌজদারি আপিল
ফৌজদারি মামলার বিষয়ে তিনটি ক্ষেত্রে হাইকোর্টের রায় , ডিক্রি বা চূড়ান্ত আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টে আপিল করা যায় —
1. নিম্নতম আদালতের রায়ে নির্দোষ বলে প্রমাণিত কোনো ব্যক্তিকে হাইকোর্ট মৃত্যুদণ্ড দিলে ,
2. নিম্নতম আদালত থেকে কোনো মামলা নিজের হাতে তুলে নিয়ে হাইকোর্ট অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দিলে ,
3. কোনো মামলা সুপ্রিমকোর্টে আপিল যোগ্য বলে হাইকোর্ট প্রমাণপত্র দিলে ।
তা ছাড়া বর্তমানে সংবিধানের ১৩৪ ( ২ ) নং ধারা অনুসারে পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রণীত ১৯৬৯ সালের একটি আইন অনুযায়ী স্বল্পমেয়াদি অথবা দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ডাদেশ প্রাপ্ত যে কোনো নাগরিক সুপ্রিমকোর্টে আপিল করতে পারে ।
বিশেষ অনুমতি সূত্রে আপিল
সংবিধানের ১৩৬ ( ১ ) নং ধারা অনুযায়ী ভারতের সামরিক আদালত বা সামরিক ট্রাইব্যুনাল ছাড়া যে কোনো আদালত বা ট্রাইব্যুনালের রায় , আদেশ বা দণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল করার জন্য সুপ্রিমকোর্ট ‘ বিশেষ অনুমতি ’ দিতে পারে ।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে , ১৯৭৮ সালে ৪৪ তম সংবিধান সংশোধনের পর থেকে হাইকোের্ট মামলার রায় দেওয়ার সময়েই সুপ্রিমকোর্টে আপিলের অনুমতি দিতে পারে , অথবা বিবদমান কোনো পক্ষের মৌখিক আবেদনের ভিত্তিতে তৎক্ষণাৎ আপিলের অনুমতি দিতে পারে ।
পরামর্শদান এলাকা
সংবিধানের ১৪৩ ( ১ ) নং ধারা অনুযায়ী , রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন আইন বা তথ্য সংক্রান্ত বিষয়ে কোনো সর্বজনীন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে বা দিতে পারে তাহলে তিনি সে বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টের কাছে পরামর্শ চাইতে পারেন । এক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্ট পরামর্শ দিতে বাধ্য নয় । তবে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শুনানির পর সুপ্রিমকোর্ট তার মতামত জানাতে পারে ।
তা ছাড়া সংবিধান চালু হওয়ার আগে সম্পাদিত সন্ধি , চুক্তি , অঙ্গীকার পত্র , সনদ ইত্যাদির মধ্যে যেগুলি সংবিধান চালু হওয়ার পরও বলবৎ আছে সেগুলির বিষয়ে কোনো বিরোধ দেখা দিলে রাষ্ট্রপতি সুপ্রিমকোর্টের পরামর্শ চেয়ে পাঠাতে পারেন [ ১৪৩ ( ২ ) নং ধারা ] । এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দিতে সুপ্রিমকোর্ট বাধ্য । অবশ্য সুপ্রিমকোর্টের পরামর্শ মতো কাজ করতে রাষ্ট্রপতি বাধ্য নন ।
নির্দেশ , আদেশ বা লেখ জারির এলাকা
ভারতের নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলি সংরক্ষণের দায়িত্ব সুপ্রিমকোর্টের ওপর ন্যস্ত । মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হলে তা বলবৎ ও কার্যকর করার জন্য নাগরিকরা সুপ্রিমকোর্টে আবেদন করতে পারে । সুপ্রিমকোর্ট এই উদ্দেশ্যে বন্দি প্রত্যক্ষীকরণ , পরমাদেশ , প্রতিষেধ , অধিকার পৃচ্ছা , উৎপ্রেষণ প্রভৃতি নির্দেশ , আদেশ বা লেখ জারি করতে পারে ।
অন্যান্য ক্ষমতা
উপরিউক্ত ক্ষমতাগুলি ছাড়াও সুপ্রিমকোর্টের আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা রয়েছে । যেমন , সংবিধানের ১২৯ নং ধারা অনুযায়ী সুপ্রিমকোর্টের অভিলেখ আদালত বা Court of Record হিসেবে কাজ করার ক্ষমতা রয়েছে । বিভিন্ন মামলায় নিজের দেওয়া যে কোনো রায় বা আদেশ পুনর্বিবেচনা করার অধিকারও সুপ্রিমকোর্টের আছে ।
সংবিধানের ১৪২ ( ২ ) নং ধারা অনুযায়ী , আদালত অবমাননার জন্য সুপ্রিমকোর্ট অবমাননাকারীর শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা করতে পারে । সংবিধানের ১৪১ নং ধারা অনুযায়ী সুপ্রিমকোর্ট কর্তৃক ঘোষিত বিধি অনুসরণ করা ভারতের সমস্ত আদালতের পক্ষে বাধ্যতামূলক ।
তা ছাড়া , যে কোনো বিষয়ে পূর্ণ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় ডিক্রি ও আদেশ জারি করার ক্ষমতাও সুপ্রিমকোর্টের রয়েছে । নিজের কাজকর্ম সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মী নিয়োগের ক্ষমতাও সুপ্রিমকোর্টের হাতে দেওয়া হয়েছে ।