ভারতীয় পার্লামেন্টের সাধারণ বিল পাশের পদ্ধতি
Contents
ভারতীয় পার্লামেন্টের সাধারণ বিল পাশের পদ্ধতি
ভারতীয় সংবিধানে ১০৭ থেকে ১২২ নং ধারার মধ্যে পার্লামেন্টের আইন পাসের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে । আইন প্রণয়ন পার্লামেন্টের একটি প্রধান কাজ । বিল উত্থাপন করা থেকে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন লাভ পর্যন্ত কয়েকটি পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে একটি বিলকে যেতে হয় ।
সরকারি বা বেসরকারি যে কোনো বিল উত্থাপনের আগে একটি প্রস্তুতি পর্ব চলে । বেসরকারি বিল উত্থাপনের একমাস আগে একটি নোটিশ দিতে হয় । লোকসভা অথবা রাজ্যসভা যে কোনো কক্ষে সাধারণ বিল উত্থাপন করা যায় । বেসরকারি বিলের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কক্ষের অনুমতির প্রয়োজন হয় ।
সরকারি বিল উত্থাপনের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন সংশ্লিষ্ট দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী । সরকারি বিল উত্থাপন করার আগে সে সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় ক্যাবিনেট । ক্যাবিনেটের অনুমোদনের পর পার্লামেন্টের সম্মতি গ্রহণের জন্য রাজ্যসভা অথবা লোকসভা যে কোনো কক্ষে বিলটি উত্থাপিত হয় । একটি সাধারণ বিল সাতটি পর্যায় পার হয়ে আইনে পরিণত হয় ।
প্রথম পর্যায়
বিলের প্রথম পর্যায়ে রয়েছে বিল উত্থাপন ও বিলের প্রথম পাঠ । বিলটি যদি লোকসভায় উত্থাপিত হয় তাহলে স্পিকারের কাছে এবং রাজ্যসভায় উত্থাপিত হলে চেয়ারম্যানের কাছে অনুমতি নিয়ে উত্থাপককে সভায় বিল পেশ করতে হয় । এই পর্যায়ে শুধুমাত্র বিলের Title বা শিরোনাম পাঠ করা হয় । কোনো আলোচনা বা বিতর্ক এই পর্যায়ে হয় না । তবে উত্থাপক প্রয়োজন বোধে বিলটির উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি ব্যাখ্যা করতে পারেন । নিয়মানুসারে উত্থাপিত হওয়ার পর বিলটি সরকারি গেজেটে প্রকাশিত হয় ।
দ্বিতীয় পর্যায়
বিল উত্থাপনের কয়েকদিন পর বিলের দ্বিতীয় পাঠ শুরু হয় । এই পর্যায়ে উত্থাপক বিল সম্পর্কে যে কোনো একটি প্রস্তাব পেশ করতে পারেন । যেমন—
1. বিলটি সভায় বিচার বিবেচনার জন্য গ্রহণ করা হোক ;
2. পার্লামেন্টের সিলেক্ট কমিটিতে বিলটি পাঠানো হোক ;
3. পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের যুক্ত কমিটির কাছে বিলটি পাঠানো হোক ;
4. জনসাধারণের মতামত জানার জন্য বিলটি প্রচার করা হোক ।
তৃতীয় পর্যায়
বিলের তৃতীয় পর্যায়ে বিলটি নিয়ে সামগ্রিক বিচার বিবেচনা করা হয় । বিলের এই পর্যায়কে কমিটি পর্যায় বলে । কোনো বিল সিলেক্ট কমিটির কাছে পাঠানো হলে সংশ্লিষ্ট বিল নিয়ে কমিটি ব্যাপক আলোচনা করতে পারে , কিন্তু বিলের নীতি বা উদ্দেশ্য পরিবর্তনের ক্ষমতা কমিটির নেই । অবশ্য বিলের কোনো অংশের সংশোধনের জন্য কমিটি তার প্রস্তাব রাখতে পারে ।
কমিটি প্রয়োজন বোধে বিলের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গ , প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির বক্তব্য শুনতে পারে অথবা কোনো সাক্ষ্য গ্রহণ করতে পারে , বা বিশেষ কারণে সরকারকে সংশ্লিষ্ট দলিল ও তথ্য পেশ করতেও বলতে পারে । কমিটি সবশেষে বিলটি সম্পর্কে তার সুচিন্তিত মতামত সংসদে উপস্থাপন করে ।
চতুর্থ পর্যায়
এই পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট বিলের প্রতিটি ধারা উপধারা নিয়ে সবিস্তার আলোচনা ও তর্ক বিতর্ক হয় । সভার যে কোনো সদস্য বিলটির উপরে সংশোধনী প্রস্তাব আনতে পারেন । অবশ্য সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপনের কমপক্ষে একদিন আগে সভায় বিজ্ঞপ্তি দিতে হয় । আলোচনা ও তর্ক বিতর্কের শেষে বিলের প্রতিটি ধারা ও উপধারা নিয়ে ভোটাভুটির পর বিলের দ্বিতীয় পাঠের সমাপ্তি ঘটে ।
পঞ্চম পর্যায়
এই পর্যায়ে বিলের তৃতীয় পাঠ অনুষ্ঠিত হয় । দ্বিতীয় পাঠ শেষ হওয়ার পরে যে কোনো দিন বিলের তৃতীয় পাঠের সূচনা করে সংশ্লিষ্ট কক্ষে বিলটি গ্রহণ করার জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয় । এই পর্যায়ে বিলের ধারা উপধারা নিয়ে কোনো রকম আলোচনা বা তর্ক বিতর্ক হয় না , এমনকি সংশোধনী প্রস্তাবও উত্থাপন করা যায় না । বিলটি গৃহীত হবে না প্রত্যাখ্যাত হবে তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ।
সংখ্যা গরিষ্ঠ সদস্য বিলটিকে সমর্থন করলে বিলটি গৃহীত হয় । অন্যদিকে সমর্থন না পেলে বিলটি বাতিল বলে গণ্য হয় । এইভাবে বিলটি লোকসভায় গৃহীত হলে স্পিকারকে অথবা রাজ্যসভায় গৃহীত হলে চেয়ারম্যানকে সে সম্পর্কে সার্টিফিকেট দিতে হয় ।
ষষ্ঠ পর্যায়
বিল পাশের ষষ্ঠ পর্যায়ে রয়েছে অপর কক্ষের অনুমোদনের বিষয় । বিলটি যে কোনো একটি কক্ষে গৃহীত হওয়ার পর তা অনুমোদনের জন্য অপর কক্ষে যায় । সেই কক্ষেও বিলটিকে উপরিউক্ত পর্যায়গুলি অতিক্রম করতে হয় । কোনোরকম সংশোধনী ছাড়াই বিলটি অপর কক্ষে গৃহীত হলে বিল অনুমোদনের ষষ্ঠ পর্যায় শেষ হয় ।
অপর কক্ষ অবশ্য বিলে সম্মতি না দিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করতে বা সংশোধনী প্রস্তাব আনতে অথবা ছয় মাসের জন্য আটকে রাখতে পারে । তবে কোনো বিল নিয়ে দুটি কক্ষের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিলে সে সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতি উভয় কক্ষের যৌথ অধিবেশন ডাকতে পারেন । যৌথ অধিবেশনে সংখ্যা গরিষ্ঠের ভোটে বিলটি অনুমোদিত হয় ।
সপ্তম পর্যায়
সপ্তম ও শেষ পর্যায় হল রাষ্ট্রপতির সম্মতি জ্ঞাপনের পর্যায় । পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে বিলটি গৃহীত হওয়ার পর তা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হয় । রাষ্ট্রপতি সংশ্লিষ্ট বিলটিতে সম্মতি দিলে বিলটি তৎক্ষণাৎ আইনে পরিণত হয় । অবশ্য রাষ্ট্রপতির অসম্মতি জানানোর ক্ষমতাও রয়েছে ।
এ ছাড়া রাষ্ট্রপতি কোনো বিলকে পুনর্বিবেচনার জন্য পার্লামেন্টের কাছে ফেরত পাঠাতেও পারেন । তবে পার্লামেন্ট সংশ্লিষ্ট বিলটিকে পুনরায় অনুমোদন করে পাঠালে রাষ্ট্রপতি তাতে সম্মতি দিতে বাধ্য থাকেন । এভাবে একটি বিল লোকসভা , রাজ্যসভা ও রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে আইনে পরিণত হয় ।