লোকসভার গঠন ক্ষমতা ও কার্যাবলী
Contents
লোকসভার গঠন ক্ষমতা ও কার্যাবলী
লোকসভার গঠন
ভারতীয় পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভা জনগণের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে গঠিত হয় । এই কারণে লোকসভাকে জনপ্রতিনিধি কক্ষ ( Popular House ) বলে অভিহিত করা হয় । লোকসভা সর্বাধিক ৫৫২ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হয় । তার মধ্যে নির্বাচিত সদস্য সংখ্যা অনধিক ৫৫০ জন এবং ২ জন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনোনীত সদস্য । বর্তমানে অঙ্গরাজ্যগুলি থেকে ৫৩০ জন , কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলি থেকে ১৩ জন এবং রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনোনীত দুজন ইঙ্গ-ভারতীয় সদস্যকে নিয়ে সর্বমোট ৫৪৫ জন সদস্য লোকসভায় রয়েছেন ।
লোকসভার কার্যকালের মেয়াদ পাঁচ বছর । রাষ্ট্রপতি লোকসভার অধিবেশন আহ্বান করে থাকেন । লোকসভার প্রথম অধিবেশনে সদস্যরা নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে অধ্যক্ষ ( Speaker ) এবং অন্য একজনকে উপাধ্যক্ষ ( Deputy Speaker ) নির্বাচন করেন ।
লোকসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলী
লোকসভার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা ও কার্যাবলী হল—
আইন প্রণয়ন :
আইনসভ জনপ্রতিনিধি কক্ষরূপে লোকসভার প্রধান কাজ হল আইন প্রণয়ন । সাধারণ বিল উত্থাপন ও অনুমোদনের ক্ষেত্রে লোকসভার প্রয়োজনীয় ক্ষমতা রয়েছে । সাধারণ বিলের বিষয়ে কিছু ক্ষেত্রে রাজ্যসভার তুলনায় লোকসভার প্রাধান্য দেখা যায় ।
অর্থ সংক্রান্ত ক্ষমতা :
অর্থবিলের ব্যাপারে লোকসভা অনন্য ক্ষমতার অধিকারী । অর্থবিল একমাত্র লোকসভাতেই উত্থাপিত হতে পারে । তা ছাড়া কোনো বিল অর্থবিল কি না , সে বিষয়ে মত বিরোধ ঘটলে লোকসভার অধ্যক্ষের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত । কোনো অর্থবিল প্রত্যাখ্যান বা সংশোধন করার ক্ষমতা পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভাকে দেওয়া হয়নি । লোকসভায় পাস হওয়া অর্থবিল সম্পর্কে রাজ্যসভাকে ১৪ দিনের মধ্যে তার মতামত জানাতে হয় । বিলটি এই সময়ের মধ্যে ফেরত না এলে তা গৃহীত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয় ।
সরকারের আয়-ব্যয় নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও লোকসভার কর্তৃত্ব লক্ষ করা যায় । লোকসভার অনুমোদন ছাড়া সরকার কোনো অর্থ ব্যয় , নতুন কর ধার্য অথবা পুরোনো করের পুনর্বিন্যাস বা বিলোপ ঘটাতে পারে না । এ ছাড়া মঞ্জুরিকৃত অর্থ নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় করা হয়েছে কি না , বা সরকারি আয়-ব্যয় ব্যবস্থা যথাযথভাবে পরিচালিত হয়েছে কি না , তা দেখার জন্য রাজ্যসভার সঙ্গে যুগ্মভাবে লোকসভা সরকারি গাণিতিক কমিটি ( Public Accounts Committee ) এবং আনুমানিক ব্যয় পরীক্ষা কমিটি ( Estimates Committee ) র মাধ্যমে তদারক করতে পারে ।
মন্ত্রীসভা গঠন ও নিয়ন্ত্রণ :
সংসদীয় শাসন ব্যবস্থার রীতি অনুসারে , লোকসভার সংখ্যা গরিষ্ঠ দলের সদস্যদের নিয়ে মন্ত্রীসভা গঠিত হয়ে থাকে । রাষ্ট্রপতি লোকসভার সংখ্যা গরিষ্ঠ দলের বা জোটের নেতা বা নেত্রীকে মন্ত্রীসভা গঠনের জন্য আহ্বান করেন । সাধারণত লোকসভার সংখ্যা গরিষ্ঠ দল বা জোট থেকেই প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রীরা নিযুক্ত হন । অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমও ঘটতে পারে , যেমন— কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ‘ সংযুক্ত প্রগতিশীল জোট ’ ( U.P.A. ) এর নেতা হিসেবে রাজ্যসভার সদস্য ড. মনমোহন সিং এর প্রধানমন্ত্রী পদে নিযুক্তি ।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা শুধুমাত্র পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভার কাছে দায়বদ্ধ । লোকসভায় মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পাস হলে সমগ্র মন্ত্রীসভাকে পদত্যাগ করতে হয় । কাজেই মন্ত্রীসভার স্থায়িত্ব লোকসভার সংখ্যা গরিষ্ঠ সদস্যের আস্থার ওপর নির্ভরশীল ।
শাসন বিভাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ :
লোকসভার সদস্যদের সরকার বা শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রয়েছে । লোকসভার অধিবেশন চলাকালীন মন্ত্রীদের প্রশ্ন জিজ্ঞাসা , মুলতবি প্রস্তাব উত্থাপন , সরকারি নীতি ও কর্মসূচির সমালোচনা , নিন্দাসূচক প্রস্তাব বা অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন , পার্লামেন্টীয় কমিটির প্রতিবেদনের মাধ্যমে সরকারি কাজকর্মের মূল্যায়ন প্রভৃতির মাধ্যমে লোকসভার সদস্যরা মন্ত্রীসভা বা শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন ।
নির্বাচন ও পদচ্যুতি :
রাষ্ট্রপতির নির্বাচন ও পদচ্যুতির বিষয়ে এবং উপরাষ্ট্রপতির নির্বাচনের ক্ষেত্রে লোকসভার প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক ক্ষমতা রয়েছে । রাজ্যসভার উত্থাপিত উপরাষ্ট্রপতির পদচ্যূতি সংক্রান্ত প্রস্তাব লোকসভার সম্মতি ছাড়া কার্যকরী হয় না । এ ছাড়া সুপ্রিমকোর্ট এবং হাইকোর্টের বিচারপতি , মুখ্য নির্বাচন কমিশনার , নিয়ন্ত্রক ও মহাগণনা পরীক্ষক প্রমুখ পদাধিকারীকে অপসারণের ক্ষমতাও লোকসভার রয়েছে ।
সংবিধান সংশোধন :
সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে লোকসভা উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার সঙ্গে সমান ক্ষমতা ভোগ করে । উভয় কক্ষের সম্মতি ছাড়া সংবিধান সংশোধন করা যায় না ।
শাস্তি প্রদান :
রাজ্যসভার সঙ্গে যুগ্মভাবে লোকসভা কোনো সদস্য বা সদস্য নন এমন ব্যক্তিকে আইনসভার অবমাননা বা অধিকার ভঙ্গের অভিযোগে শাস্তি দিতে পারে ।
জরুরি অবস্থার ঘোষণা অনুমোদন :
রাষ্ট্রপতি কর্তৃক জাতীয় জরুরি অবস্থা , আর্থিক জরুরি অবস্থা এবং অঙ্গরাজ্যগুলিতে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা জনিত জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিষয়টি লোকসভার অনুমোদন সাপেক্ষ । ৪৪ তম সংবিধান সংশোধনী অনুযায়ী , জাতীয় জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের ব্যাপারে লোকসভা কোনো প্রস্তাব গ্রহণ করলে রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করতে বাধ্য থাকেন ।
নতুন রাজ্য গঠন ও রাজ্য পুনর্গঠন :
নতুন রাজ্য গঠন , রাজ্য পুনর্গঠন অথবা কোনো রাজ্যের সীমানার হ্রাস বৃদ্ধি , নাম পরিবর্তন ইত্যাদি ক্ষেত্রেও লোকসভা ক্ষমতা ভোগ করে থাকে ।
অন্যান্য ক্ষমতা :
কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে হাইকোর্ট স্থাপন , কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে হাইকোর্টের ক্ষমতার পরিধি বাড়ানো প্রভৃতি বিষয়ে লোকসভা উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার সঙ্গে যুগ্ম ক্ষমতার অধিকারী । এ ছাড়া রাজ্য আইনসভার উচ্চকক্ষ বিধান পরিষদের প্রবর্তন বা বিলোপ সাধন , সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বসবাসগত যোগ্যতা নির্ধারণ প্রভৃতি বিষয়ে লোকসভার প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক ক্ষমতা রয়েছে ।
উপসংহার
ভারতের সংসদীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলী অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে । দেশের সংসদীয় গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে লোকসভা এক ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে চলেছে ।