বিপ্লবী আন্দোলনে বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর অবদান
Contents
বিপ্লবী আন্দোলনে বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর অবদান

বাংলা ও পাঞ্জাবের বিপ্লবী আন্দোলনের প্রাণ পুরুষ ছিলেন রাসবিহারী বসু ( ১৮৮৫ – ১৯৪৫ খ্রি. ) । বিপ্লবী জীবনের প্রথমদিকে ভারতের মধ্যে এবং পরবর্তীকালে বিদেশে অবস্থান করেও তিনি ভারতের স্বাধীনতার জন্য যে বিপ্লবী প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন তাতে তাঁকে ভারতের বিপ্লববাদের পিতা বললে ভুল বলা হয় না । বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ছদ্মনামে এবং বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ছদ্মবেশে রাসবিহারীর বৈপ্লবিক কার্যকলাপ ব্রিটিশ সরকারের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল ।
বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর প্রথম জীবন
প্রথম জীবনে রাসবিহারী বসু দেরাদুনের কেন্দ্রীয় সরকারের ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউশনের একজন চাকরিজীবী ছিলেন । এই সময় থেকেই চন্দন নগরের বিপ্লবী দলের সঙ্গে তাঁর যােগাযােগ ছিল । প্রথম দিকে তিনি গােপনে অনুশীলন সমিতি , যুগান্তর দলের সঙ্গে যােগাযােগ রাখলেও অরবিন্দ ঘােষের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রকাশ্য বিপ্লবী জীবন শুরু করেন । ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ রদ হলে এবং দুই বাংলা পুনরায় এক হলে যে ব্যাপক বিপ্লবী কর্মকাণ্ড শুরু হয় তার অন্যতম ঋত্বিক ছিলেন রাসবিহারী ।
বড়োলাট হার্ডিঞ্জকে হত্যার চেষ্টা
১৯১২ খ্রিস্টাব্দের ২৩ ডিসেম্বর দিল্লিতে নবগঠিত রাজধানীর আনুষ্ঠানিক উদবােধন উপলক্ষ্যে বড়োলাট হার্ডিঞ্জ হাতির পিঠে চড়ে এক শােভাযাত্রায় বের হন । রাসবিহারীর পরিকল্পনা মাফিক বসন্ত বিশ্বাস দিল্লির চাঁদনিচকের এক বাড়ির ঝোলা বারান্দা থেকে হাতি লক্ষ করে বোমা ছোড়েন। হার্ডিঞ্জ আহত হন ও তাঁর অনুচর নিহত হন । বসন্ত বিশ্বাস ধরা পড়লেও রাসবিহারী পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে বারানসী হয়ে পাঞ্জাব চলে যান । শুরু হয় দিল্লি ষড়যন্ত্র মামলা , যার রায়ে বসন্ত বিশ্বাসসহ আমীরচাঁদ , অবোধ বিহারী , বালমুকুন্দ প্রমুখের ফাঁসি হয়। রাসবিহারীর মাথার দাম ধার্য হয় ১ লক্ষ টাকা ।
গর্ডন হত্যার চেষ্টা
পাঞ্জাব থেকেও রাসবিহারী তাঁর বিপ্লবী প্রয়াস অব্যাহত রাখেন । রাসবিহারী বসুর গােপন নির্দেশ অনুযায়ী বিপ্লবীরা পাঞ্জাবের সহকারী পুলিশ কমিশনার গর্ডন – কে হত্যা করার চেষ্টা করেন । কিন্তু এতে একজন চাপরাশির মৃত্যু ঘটে , গর্ডন সাহেবের কোনাে ক্ষতি হয়নি । তবুও রাসবিহারীর এই ব্রিটিশ নিধনের ছক ব্রিটিশকে যথেষ্ট উদবিগ্ন করে তোলে ।
বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর উত্তর ভারতে বিপ্লব প্রচেষ্টা
গণ অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা :
লাহাের , মিরাট , রাওয়ালপিণ্ডি , আম্বালার সেনা শিবিরগুলি – সহ সমগ্র উত্তর ভারত জুড়ে রাসবিহারী বিপ্লবী প্রচার শুরু করেন । ইউরােপে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশের ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে রাসবিহারী লাহােরকে কেন্দ্র করে উত্তর ভারতে এক গণবিদ্রোহ ও সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানাের পরিকল্পনা নেন । স্থির হয় ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি দুটি পাঞ্জাব রেজিমেন্ট বিদ্রোহ করবে । তারপর অন্য সেনা নিবাসের সেনারা তাতে যােগ দেবে । কিন্তু কৃপাল সিং নামে পুলিশের এক চর পুলিশকে সব জানিয়ে দিলে বিদ্রোহের দিন দুদিন এগিয়ে ১৯ ফেব্রুয়ারি নির্ধারিত হয়।
লাহাের ষড়যন্ত্র মামলা :
গণ অভ্যুত্থানের সংবাদ ফাঁস হয়ে যাওয়ায় রাসবিহারীর এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। শুরু হয় লাহাের ষড়যন্ত্র মামলা ( ১৯১৫ খ্রি. ) । এই ষড়যন্ত্র মামলার রায়ে রাসবিহারীর দুই বিশ্বস্ত সহকর্মী কর্তার সিং ও বিষ্ণু গণেশ পিংলেসহ মােট ১৭ জনের প্রাণদণ্ড ও বহু বিপ্লবীর যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হয়।
জাপানে বিপ্লবীজীবন
লাহাের ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার পর রাসবিহারী আর ভারতে থাকা নিরাপদ নয় ভেবে পি. এন. ঠাকুর ছদ্মনাম নিয়ে এস. এস. সারুকিমারু জাহাজে করে জাপানে চলে যান। জাপান থেকেই রাসবিহারী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা ভারতীয় বিপ্লবীদের সঙ্গে যােগাযােগ গড়ে তোলার চেষ্টা শুরু করেন। জাপানি সরকার তার নামে গ্রেফতারি পরােয়ানা জারি করলে তিনি সেখানকার ‘ ব্ল্যাক ড্রাগন ‘ সোসাইটির নেতা্ এম. টোয়ামার সাহায্যে ৮ বছর গা ঢাকা দিয়ে থাকেন। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে রাসবিহারী ক্যাপ্টেন মোহন সিং – এর সাহায্যে জাপানে যুদ্ধবন্দি ভারতীয়দের নিয়ে ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেনডেন্স লিগ গঠন করেন । এই মহান বিপ্লবী স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন নিয়ে জাপানেই শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন ( ১৯৪৫ খ্রি. )।