ভারতের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও কার্যাবলী
Contents
ভারতের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও কার্যাবলী
সংবিধানের ৫৩ ( ১ ) নং ধারা অনুসারে , কেন্দ্রের কার্যনির্বাহী ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে ( “ The executive power of the Union shall be vested in the President ‘ ) । সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে যে প্রভূত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তা কয়েকটি ভাগে আলোচনা করা যেতে পারে—
শাসন সংক্রান্ত ক্ষমতা
ভারতের রাষ্ট্রপতিকে দেশের সর্বোচ্চ প্রশাসক হিসেবে অভিহিত করা হয় । সংবিধান অনুযায়ী তিনি নিজে বা তাঁর অধস্তন কর্মচারীদের মাধ্যমে শাসন সংক্রান্ত কার্যাবলি পরিচালনা করতে পারেন ।
নিয়োগ সংক্রান্ত :
ভারত রাষ্ট্রের প্রকৃত শাসক প্রধানমন্ত্রীসহ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার অন্যান্য সদস্য , ভারতের অ্যাটর্নি জেনারেল , সর্বোচ্চ ব্যয় নিয়ন্ত্রক ও মহাগণনা পরীক্ষক , নির্বাচন কমিশনার , কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশনের সদস্য , অঙ্গরাজ্যের রাজ্যপাল প্রমুখ উচ্চপদাধিকারীকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করেন । এদের অনেককে তিনি অপসারণ করতে পারেন ।
সামরিক :
সংবিধান অনুযায়ী ভারতীয় সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হলেন রাষ্ট্রপতি । তিনি স্থল , নৌ এবং বিমান বাহিনীর প্রধানদের নিয়োগ করেন । যুদ্ধ ঘোষণা বা শান্তি স্থাপন করার ক্ষমতাও রাষ্ট্রপতির রয়েছে । অবশ্য সংসদের অনুমতি ছাড়া রাষ্ট্রপতির এসব সিদ্ধান্ত বলবৎ হয় না । রাষ্ট্রপতি জাতীয় প্রতিরক্ষা কমিটির প্রধান হিসেবে তাঁর ভূমিকা পালন করেন ।
কূটনৈতিক :
বিদেশে ভারতের যাবতীয় সরকারি কাজকর্ম রাষ্ট্রপতির নামে সম্পাদিত হয় । ভারতের বৈদেশিক কূটনীতিকদের নিয়োগ করেন রাষ্ট্রপতি । অন্যান্য দেশ থেকে আসা কূটনীতিকদের তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেন । আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি হলেন জাতির প্রতিনিধি । সব ধরনের আন্তর্জাতিক সন্ধি ও চুক্তি রাষ্ট্রপতির নামে সম্পাদিত হয় ।
তত্ত্ববধান সংক্রান্ত :
ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির শাসন ব্যবস্থা রাষ্ট্রপতির অধীনে পরিচালিত হয় । তা ছাড়া কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রপতির হাতে কিছু বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে । উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলগুলির বিষয়েও রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে । রাষ্ট্রপতি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কমিশন গঠন করে থাকেন । এ ছাড়া রাজ্যগুলির কাছে প্রয়োজন মতো প্রশাসনিক নির্দেশ পাঠানোর ক্ষমতাও রাষ্ট্রপতির রয়েছে ।
আইন সংক্রান্ত ক্ষমতা
ভারতের রাষ্ট্রপতি আইনসভা বা সংসদের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হন । রাষ্ট্রপতির আইন সংক্রান্ত ক্ষমতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—
অধিবেশন সংক্রান্ত :
রাষ্ট্রপতি সংসদের উভয় কক্ষের অধিবেশন আহ্বান করতে কিংবা অধিবেশন স্থগিত রাখতে পারেন । রাষ্ট্রপতি লোকসভার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে তা ভেঙে দিতেও পারেন । তবে সংসদের অধিবেশন আহ্বান বা স্থগিত রাখার বিষয়ে অথবা লোকসভা ভেঙে দেওয়ার ব্যাপারে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করেন ।
অর্থবিল ছাড়া অন্যান্য বিল অনুমোদনের ক্ষেত্রে সংসদের উভয় কক্ষের মত বিরোধে অচলাবস্থা সৃষ্টি হলে রাষ্ট্রপতি যৌথ অধিবেশন ডেকে তার অবসান ঘটাতে পারেন । সংসদের কোনো সদস্যের যোগ্যতার বিষয়ে প্রশ্ন উঠলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনের কাছে সে সম্পর্কে রিপোর্ট চাইতে পারেন এবং কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারেন ।
মনোনয়ন প্রদান :
সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় রাষ্ট্রপতি ১২ জন কৃতী ব্যক্তিকে সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দিতে পারেন । এ ছাড়া লোকসভায় ইঙ্গ-ভারতীয় ( Anglo Indian ) সম্প্রদায়ের যথোচিত সংখ্যক প্রতিনিধি নেই মনে করলে রাষ্ট্রপতি ওই সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকে অনধিক দুজনকে লোকসভার সদস্য হিসেবে মনোনীত করতে পারেন ।
যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দান :
সংসদের যে কোনো কক্ষে বা উভয় কক্ষের যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দেওয়ার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির রয়েছে । তাঁর এই ভাষণে মন্ত্রীসভার নীতি ও কর্মসূচি ঘোষণা করা হয় । তা ছাড়া কোনো বিল বা অন্য কোনো বিষয়ে রাষ্ট্রপতি বার্তা ( Message ) পাঠাতে পারেন ।
বিলে সম্মতি দান :
উভয় কক্ষে পাস হওয়া প্রতিটি বিল রাষ্ট্রপতির সম্মতি ছাড়া আইনে পরিণত হতে পারে না । অর্থবিল ছাড়া অন্য যে কোনো বিলে রাষ্ট্রপতি সম্মতি দিতে পারেন বা নাও পারেন অথবা বিলটিকে পুনর্বিবেচনার জন্য সংসদের কাছে ফেরত পাঠাতে পারেন । কিন্তু সংশ্লিষ্ট বিলটি সংসদের উভয় কক্ষে পুনরায় দ্বিতীয়বার গৃহীত হলে রাষ্ট্রপতি তাতে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য থাকেন ( ১১১ নং ধারা ) ।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে , সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত কোনো বিল সংসদের উভয় সভায় গৃহীত হলে রাষ্ট্রপতি তাতে অসম্মতি জানাতে পারেন না । সংবিধান অনুযায়ী , রাজ্য আইনসভায় পাস হওয়া বিল রাজ্যপালের কাছে পাঠানো হয় । রাজ্যপাল এক্ষেত্রে বিলটিতে অনুমোদন না দিয়ে রাষ্ট্রপতির বিবেচনার জন্য তা পাঠিয়ে দিতে পারেন ( ২০১ নং ধারা ) ।
অর্ডিন্যান্স জারি :
সংসদের অধিবেশন বন্ধ থাকাকালীন বিশেষ প্রয়োজনে রাষ্ট্রপতি অর্ডিন্যান্স জারি করতে পারেন । এসব অর্ডিন্যান্স সংসদ আইনের মতো সমান কার্যকরী হয় ।
আগম সম্মতিদান :
কয়েকটি বিল পার্লামেন্টে পেশ করার আগে রাষ্ট্রপতির সম্মতির প্রয়োজন হয় । সেগুলি হল নতুন রাজ্য গঠন , রাজ্যের নাম ও সীমানা পরিবর্তন সংক্রান্ত বিল ইত্যাদি । কয়েকটি প্রতিবেদন বা রিপোর্ট রাষ্ট্রপতির নির্দেশে সংসদে পেশ করা হয় । এর মধ্যে রয়েছে বাজেট ও অতিরিক্ত বাজেট , অর্থ কমিশনের সুপারিশ , রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশনের রিপোর্ট প্রভৃতি ।
অর্থ সংক্রান্ত ক্ষমতা
সংবিধান অনুসারে –
অর্থবিল অনুমোদন :
রাষ্ট্রপতির পূর্ব সুপারিশ ছাড়া কোনো অর্থবিল লোকসভায় উত্থাপন করা যায় না । ঋণ সংক্রান্ত রাজস্ব প্রস্তাব বা সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপনের জন্যও রাষ্ট্রপতির অনুমোদন প্রয়োজন হয় ।
বাজেট প্রস্তাবনা :
প্রত্যেক আর্থিক বছরের জন্য সরকারের আনুমানিক আয়-ব্যয়ের বিবরণী বা বাজেট অর্থমন্ত্রীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি সংসদে উত্থাপন করেন ।
আপৎকালীন ব্যয় নির্বাহ :
আপৎকালীন ব্যয় নির্বাহের জন্য ভারতে যে আকস্মিক ব্যয় সংকুলান তহবিল ( Contingency Fund of India ) রয়েছে , তার দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে ।
অর্থ কমিশন গঠন :
কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির মধ্যে রাজস্ব বণ্টনের জন্য প্রতি পাঁচ বছর অন্তর একটি অর্থ কমিশন গঠন করার ক্ষমতাও রাষ্ট্রপতির হাতে দেওয়া হয়েছে ।
বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতা
রাষ্ট্রপতির বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে—
বিচারপতি নিয়োগ :
সুপ্রিমকোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতিদের নিয়োগ করার ক্ষমতা । সংসদের সুপারিশে এই বিচারপতিদের অপসারণ করার ক্ষমতাও রাষ্ট্রপতির হাতে রয়েছে ।
দণ্ডিত ব্যক্তিদের ক্ষমা প্রদর্শন :
ফৌজদারি মামলায় দণ্ডাজ্ঞা প্রাপ্ত ব্যক্তির দণ্ডাদেশ স্থগিত রাখা বা হ্রাস করা অথবা দণ্ডাজ্ঞা প্রাপ্ত ব্যক্তিকে ক্ষমা প্রদর্শন করার ব্যাপারেও রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থা নিতে পারেন । রাষ্ট্রপতি মৃত্যু দণ্ডাজ্ঞা প্রাপ্ত ব্যক্তিকে ক্ষমা প্রদর্শন করতে বা মৃত্যুদণ্ড রদ করে অন্য দণ্ড দিতে পারেন ।
জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত ক্ষমতা
সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি তিন ধরনের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন —
জাতীয় জরুরি অবস্থা ( ৩৫২ ধারা ) :
রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন যে , যুদ্ধ , বহিরাক্রমণ বা অভ্যন্তরীণ সশস্ত্র বিদ্রোহের ফলে দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে , তাহলে তিনি সমগ্র দেশে বা দেশের কোনো অংশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন ।
রাজ্যে সাংবিধানিক অচলাবস্থা জনিত জরুরি অবস্থা ( ৩৫৬ ধারা ) :
রাজ্যপালের প্রতিবেদন বা অন্য কোনো সূত্র থেকে পাওয়া সংবাদের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন যে , ওই রাজ্যে সংবিধান অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা করা সম্ভব নয় , সেক্ষেত্রে তিনি ওই রাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা জনিত জরুরি অবস্থা জারি করতে পারেন ।
আর্থিক জরুরি অবস্থা ( ৩৬০ ধারা ) :
যদি রাষ্ট্রপতি মনে করেন যে , ভারতের বা ভারতের কোনো অংশের আর্থিক স্থায়িত্ব বা সুনাম বিনষ্ট হয়েছে বা হওয়ার সম্ভাবনা আছে , তাহলে তিনি আর্থিক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন ।
অন্যান্য ক্ষমতা
অন্যান্য ক্ষমতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল , কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশনের সদস্য সংখ্যা ও সদস্যদের কার্যকাল ও চাকরির শর্তাবলি নির্ধারণ , কেন্দ্রীয় সরকার এবং সংসদের সচিবালয়ের কর্মীদের নিয়োগ ও চাকরির শর্তাবলি নির্ধারণ , জাতীয় রাজধানী অঞ্চল দিল্লির লেফটেন্যান্ট গভর্নর ও দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীসহ মন্ত্রীসভার নিয়োগ , তপশিলি অঞ্চল ও তপশিলি উপজাতি এবং অসমের তফশিলি অঞ্চলগুলির প্রশাসনিক কাজকর্ম পরিচালনা , সুপ্রিমকোর্টের আদেশ বলবৎ করার জন্য নিয়মাবলি তৈরি করা ইত্যাদি ।
উপসংহার
ভারতের সংসদীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । লোকসভায় কোনো দল বা জোট নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হলে রাষ্ট্রপতি যে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন তা তাঁর সাংবিধানিক ক্ষমতায় এক নতুন মাত্রা সংযোজিত করেছে ।