রাষ্ট্র বিজ্ঞান

ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি

Contents

ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি

আধুনিক রাষ্ট্রে সরকারের যাবতীয় কাজকর্ম পরিচালনা করার জন্য প্রধান তিনটি বিভাগ রয়েছে । এগুলি হল — আইন বিভাগ , শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ । আইন বিভাগের কাজ আইন তৈরি করা , শাসন বিভাগের কাজ ওই আইন প্রয়োগ করা আর বিচার বিভাগের কাজ ওই আইন অনুসারে বিচার কাজ সম্পাদন করা । ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির মূল কথা হল রাষ্ট্র পরিচালনার তিন প্রধান স্তম্ভ আইন বিভাগ , শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের ক্ষমতার সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য । 

বস্তুত , ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি বলতে এমন এক ব্যবস্থাকে বোঝায় যেক্ষেত্রে সরকারের প্রধান তিনটি বিভাগ যথাক্রমে শাসন বিভাগ , আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে । 

ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির পক্ষে যুক্তি

বিভাগীয় স্বাধীনতার সংরক্ষণ : 

ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে শাসন বিভাগ , আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্যের সঙ্গে কাজকর্ম পরিচালনা করায় একে অপরের এক্তিয়ারে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পায় না , এর ফলে বিভাগীয় স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হওয়ার কোনো আশঙ্কা থাকে না । 

কর্মকুশলতার বৃদ্ধি : 

ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি বাস্তবায়িত হলে সরকারের তিনটি বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনভাবে কাজ করার যে সুযোগ লাভ করে তার ফলে তাদের কর্মকুশলতা বৃদ্ধি পায় । 

স্বৈরাচারী প্রবণতা রোধ : 

অনেকে মনে করেন ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি বাস্তবে রূপায়িত হলে সরকারের স্বৈরাচারী প্রবণতা রোধ করা সম্ভব হয় । কারণ এক্ষেত্রে আইন বিভাগ , শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ প্রায় সমমর্যাদার অধিকারী হওয়ায় কোনো একটি বিভাগের স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা হ্রাস পায় । 

দায়িত্বশীলতার বিকাশ : 

ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রয়োগের ফলে সরকারের তিনটি বিভাগের দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় । এতে কাজকর্মের তাগিদে শাসন বিভাগ , আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে দায়িত্বশীলতার বিকাশ ঘটে ।

মন্তেস্কু ও ম্যাডিসনের অভিমত : 

ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির অন্যতম প্রবক্তা মন্তেস্কুর মতে , আইন ও প্রশাসনের ক্ষমতা যদি কোনো একজন মাত্র ব্যক্তি বা ব্যক্তি সংসদের হাতে ন্যস্ত থাকে তাহলে সংষ্টি ব্যক্তি বা ব্যক্তি সংসদ স্বৈরাচারী আইন প্রণয়ন করে তাকে যথেচ্ছভাবে কাজে লাগাতে পারেন । 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের অন্যতম রূপকার ম্যাডিসন ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির সপক্ষে জোরালো যুক্তি দেখিয়ে বলেছিলেন আইন , শাসন ও বিচারের সমস্ত ক্ষমতা একই বিভাগের হাতে থাকলে তাকে স্বৈরাচারিতা বলে অভিহিত করা যায় ।

ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির বিপক্ষে যুক্তি

বাস্তবায়ন দুরূহ : 

ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির বিরুদ্ধে প্রধান সমালোচনা হল বাস্তবে এই নীতির পূর্ণ প্রয়োগ আদৌ সম্ভব নয় । কারণ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকারের প্রধান তিনটি বিভাগকে কখনোই পুরোপুরি স্বতন্ত্র করা যায় না । 

পূর্ণ প্রয়োগ অনভিপ্রেত : 

জন স্টুয়ার্ট মিল , ব্লুন্টস্‌মলি , ফাইনার , ল্যাস্কি প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে , ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিটির পূর্ণ প্রয়োগ আদৌ কাম্য নয় । অধ্যাপক ল্যাস্কির মতে আইন বিভাগ , শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে কাজ করলে এই স্বাতন্ত্র্য বিরোধ ডেকে আনবে । ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির পীঠভূমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বয়ং ম্যাডিসন ও অন্য যুক্তরাষ্ট্রীয়পন্থীরা এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিলেন যে , ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হলে প্রশাসন অচল হয়ে পড়বে । 

ব্যক্তি স্বাধীনতার রক্ষাকবচ নয় : 

গিলক্রিস্ট , স্যাবাইন প্রমুখ আধুনিক লেখকরা ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে ব্যক্তি স্বাধীনতার রক্ষাকবচ বলে মেনে নেননি । কারণ , আইন বিভাগ যদি স্বৈরাচারী হয় , তবে তার দ্বারা প্রণীত স্বৈরাচারী আইনকে কার্যকর করতে শাসন বিভাগ যেমন বাধ্য থাকে , তেমনি সেই আইন অনুসারে বিচার কার্য সম্পাদন করতে বিচার বিভাগও বাধ্য । সুতরাং , ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ কখনোই ব্যক্তি স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হতে পারে না ।

তিন বিভাগের অসম ক্ষমতা : 

সমালোচকরা শাসন বিভাগ , আইন বিভাগ ও বিচারবিভাগকে সমক্ষমতা সম্পন্ন বলতে রাজি হননি । গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনবিভাগ তুলনামূলকভাবে বেশি ক্ষমতার অধিকারী । কারণ আইনবিভাগের প্রণীত আইন অনুসরণ করে শাসনবিভাগ ও বিচারবিভাগকে চলতে হয় । সংসদীয় গণতন্ত্রে আইনসভা হল চূড়ান্ত সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী ।

জৈব মতবাদীদের সমালোচনা : 

বিখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ব্লুন্টস্‌লির মতে সরকার হল জীবদেহের মতো । দেহ থেকে মস্তিষ্ককে পৃথক করলে জীবদেহের মৃত্যু যেমন অবশ্যম্ভাবী , ঠিক তেমনি সরকারের প্রধান বিভাগগুলিকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করলে সরকারের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী । 

মার্কসবাদী সমালোচনা : 

মার্কসবাদী সমালোচকরা সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা ছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ তত্ত্বের সাফল্য সম্পর্কে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন । মার্কসবাদীদের মতে , অসমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সরকার এক বিশেষ শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করে চলে । কাজেই এই পরিস্থিতিতে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োগ অর্থহীন । 

সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় প্রয়োগ অসম্ভব : 

যেসব দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র বা মন্ত্রীসভা চালিত শাসন ব্যবস্থা রয়েছে ( যেমন – ব্রিটেন , ভারত ইত্যাদি ) , সেখানে আইনবিভাগ ও শাসনবিভাগের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় থাকায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োগ সম্ভব নয় । 

উপসংহার 

পরিশেষে বলা যায় , বাস্তবে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির পূর্ণ প্রয়োগ কখনোই কাম্য নয় । তবে আংশিক ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ বিচারবিভাগের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রয়োজন । কারণ ন্যায় ও নিরপেক্ষ বিচারের স্বার্থে বিচারবিভাগের স্বাতন্ত্র্য অপরিহার্য ।

error: Content is protected !!