আইনসভার গঠন ক্ষমতা ও কার্যাবলী
Contents
আইনসভার গঠন ক্ষমতা ও কার্যাবলী
আধুনিক রাষ্ট্রে সরকারের শক্তিশালী অঙ্গ হিসেবে শাসন বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হলেও আইনসভার একটি স্বতন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে । আইনসভা আজও কোনো দেশের পক্ষে সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান । গঠন কাঠামো বিশ্লেষণ করে আইনসভাগুলিকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে , যথা— এক কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা ও দ্বি কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা ।
এক কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা :
যেসব আইনসভা একটিমাত্র কক্ষ নিয়ে গঠিত হয় তাদের এক কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা ( Unicameral Legislature ) বলে । এক কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভায় একটি মাত্র কক্ষের মাধ্যমে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আইনসভার যাবতীয় কাজকর্ম পরিচালনা করে থাকেন । এক কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা রয়েছে তুরস্ক , বুলগেরিয়া , রুমানিয়া , পানামা প্রভৃতি রাষ্ট্রে ।
দ্বি কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা :
যেসব আইনসভা দুটি কক্ষ নিয়ে গঠিত তাকে দ্বি কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা ( Bicameral Legislature ) বলা হয় । যেখানে দ্বি কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা রয়েছে সেখানে আইনসভার নিম্নকক্ষ ( Low er House ) জনগণের ভোটে সরাসরি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হয় । এজন্য নিম্নকক্ষকে ‘ জনপ্রিয় কক্ষ’ও ( Popular Chamber ) বলা হয় । উচ্চকক্ষের গঠন কাঠামো কিছুটা ভিন্ন প্রকৃতির । উচ্চকক্ষে প্রতিনিধিত্বের নীতি সব দেশে সমান নয় ।
যেমন , ব্রিটেনের উচ্চকক্ষ লর্ড সভা সমাজের অভিজাত ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত হয় , ভারতের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভা জনগণের দ্বারা পরোক্ষভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হয় । একমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চকক্ষ সিনেটের প্রতিনিধিরা সরাসরি জনগণের ভোটের দ্বারা নির্বাচিত হন । শুধু তাই নয় , মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চকক্ষ সিনেটে সমপ্রতিনিধিত্ব নীতি অনুসারে ৫০ টি অঙ্গরাজ্যের প্রতিটি থেকে দুজন করে প্রতিনিধি পাঠানোর ক্ষমতা রয়েছে ।
ভারতের আইনসভার উচ্চকক্ষের ক্ষেত্রে অবশ্য রাজ্যগুলির সমপ্রতিনিধিত্বের নীতি অনুসৃত হয়নি । ক্ষমতা ও পদমর্যাদাগত প্রশ্নে বিভিন্ন দেশের উচ্চকক্ষের মধ্যে পার্থক্য দেখা যায় । ব্রিটেনের উচ্চকক্ষ লর্ডসভা ক্ষমতা ও পদমর্যাদাগত প্রশ্নে নিম্ন কক্ষ কমন্সসভার চেয়ে কম ক্ষমতাশালী । ভারতের রাজ্যসভার ক্ষমতা নিম্ন কক্ষ লোকসভার থেকে অনেক কম । অন্যদিকে , মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যতিক্রমী উচ্চকক্ষ সিনেটের ক্ষমতা সে দেশের নিম্নকক্ষ জনপ্রতিনিধি সভার চেয়ে অনেক বেশি ।
আইনসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলী
আধুনিক রাষ্ট্রে আইনসভার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় আইনসভার হাতে যেসব কাজকর্মের দায়িত্ব রয়েছে সেগুলি হল—
আইন প্রণয়ন :
আইনসভার প্রথম এবং প্রধান কাজ হল আইন প্রণয়ন । দেশের সংবিধানের সঙ্গে সংগতি রেখে ও পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান ক’রে আইনসভা নতুন আইন প্রণয়ন করে এবং প্রয়োজনে প্রচলিত আইন সংশোধন বা বাতিল করে । আধুনিক রাষ্ট্রে সবরকম আইন কানুনের প্রধান উৎস হল আইনসভা । বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম রাজনৈতিক ব্যবস্থা থাকার জন্য আইন প্রণয়নের পদ্ধতিতেও পার্থক্য দেখা যায় ।
আইনের খসড়া আলোচনা :
আইনসভার আইন প্রণয়নের কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল আইনের খসড়া আলোচনা । প্রকৃত আইন প্রণয়নের কাজ সুদক্ষ এবং অভিজ্ঞ সদস্যরা করে থাকেন । বিশেষ সদস্যদের নিয়ে গঠিত কমিটিগুলির এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে । কিন্তু আইনের খসড়া বা বিল সমগ্র আইনসভায় বিস্তারিত ভাবে আলোচিত হয় । আইনসভার সব সদস্য এতে অংশ নিতে পারেন । এই জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমেই সংশ্লিষ্ট আইন সম্বন্ধে জনগণের মতামত প্রতিফলিত হয় ।
শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ :
শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করা আইনসভাগুলির একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ । বিভিন্ন দেশের সাংবিধানিক কাঠামোয় তারতম্যের জন্য এক্ষেত্রেও আইনসভার ভূমিকায় পার্থক্য লক্ষ করা যায় । ভারত , গ্রেট ব্রিটেন প্রভৃতি সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রীসভার অন্যান্য সদস্য তাঁদের কাজকর্মের জন্য আইনসভার কাছে দায়বদ্ধ থাকেন ।
আইনসভায় নির্বাচিত সংখ্যা গরিষ্ঠ দলের সদস্যদের নিয়ে মন্ত্রীসভা গঠিত হয় । আইনসভার আস্থা হারালে সমগ্র মন্ত্রীসভাকে পদত্যাগ করতে হয় । সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় এভাবে আইনসভা শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা ভোগ করে ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি অনুসৃত হওয়ায় আইনসভার এ ধরনের কোনো ক্ষমতা নেই । তবে মার্কিন সংবিধানের ‘ নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের নীতি ’ অনুযায়ী আইনসভা কিছু প্রশাসনিক ক্ষমতা ভোগ করে থাকে । এগুলির মধ্যে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মী নিয়োগ , সন্ধি বা চুক্তি অনুমোদন , যুদ্ধ ঘোষণা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য ।
বিচার সংক্রান্ত কার্য সম্পাদন :
আইনসভার হাতে বিচার সংক্রান্ত কিছু ক্ষমতাও থাকে । সদস্যদের আচরণের বিচার , নির্বাচন সংক্রান্ত বিরোধের মীমাংসা , উচ্চ আদালতের বিচারকদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিচার আইনসভা করে থাকে । ভারতে ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি ও অন্যান্য উচ্চপদাধিকারীদের ক্ষেত্রে সংবিধান লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগের বিচার করার ক্ষমতা আইনসভার হাতে দেওয়া হয়েছে । ব্রিটেনে আবার আইনসভার উচ্চকক্ষ লর্ড সভা দেশের চূড়ান্ত আপিল আদালত হিসেবে কাজ করে ।
অর্থ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ :
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনসাধারণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আইনসভার মাধ্যমে জাতীয় অর্থ ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন । কর আরোপ ও কর সংগ্রহের অনুমতি , সরকারি আয়-ব্যয়ের পর্যালোচনা , ব্যয়-বরাদ্দ অনুমোদন প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ আইনসভা সম্পাদন করে ।
সংবিধান সংশোধন ও ব্যাখ্যা :
রাষ্ট্রের সংবিধান সংশোধন , সংবিধানের ব্যাখ্যা ইত্যাদি ব্যাপারে আইনসভার ক্ষমতা রয়েছে । সুইজারল্যান্ডে যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভা সংবিধানের চূড়ান্ত ব্যাখ্যাকর্তা হিসেবে কাজ করে । ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আইনসভার হাতে সংবিধান সংশোধনের যাবতীয় ক্ষমতা রয়েছে ।
নির্বাচন সংক্রান্ত কার্য সম্পাদন :
প্রায় সব দেশের আইনসভার হাতে কিছু নির্বাচন সংক্রান্ত ক্ষমতা রয়েছে । যেমন , ভারতে আইনসভার ( পার্লামেন্টের ) সদস্যরা রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতিকে নির্বাচন করেন । সুইজারল্যান্ডের আইনসভা যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিষদের সদস্যদের নির্বাচন করে । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কোনো প্রার্থী প্রয়োজনীয় সংখ্যা গরিষ্ঠতা না পেলে প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে প্রথম তিনজন প্রার্থীর মধ্যে যে কোনো একজনকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচন করার ক্ষমতা মার্কিন আইনসভার ( কংগ্রেসের ) নিম্নকক্ষ জনপ্রতিনিধি সভার রয়েছে ।
জনমত গঠন :
আইনসভায় সরকারি নীতির সাফল্য এবং ব্যর্থতা সম্বন্ধে সদস্যদের তর্ক বিতর্ক ও আলোচনা , মন্ত্রীদের সঙ্গে প্রশ্নোত্তর পর্ব ইত্যাদি বিষয় জাতীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ায় সরকারি কাজকর্ম সম্বন্ধে জনগণ অবহিত হওয়ার সুযোগ পায় । দেশ বিদেশের ঘটনাবলিতে সরকারি নীতি কী হবে তা প্রচারিত হওয়ায় জনগণের রাজনৈতিক শিক্ষার বিকাশ হয় । এভাবে জনমত গঠিত হয় ।
কমিটি ও কমিশন নিয়োগ :
আইনসভা বিভিন্ন ধরনের অনুসন্ধান কাজের জন্য কমিটি নিয়োগ করে । দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যাগুলি সম্বন্ধে যথাযথভাবে অবহিত হওয়ার জন্য কমিটিগুলির সাহায্য নেওয়া হয় । তা ছাড়া অনেক সময় দুর্নীতির তদন্তে কমিশনও নিয়োগ করে আইনসভা । এ প্রসঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রপতি নিকসনের ‘ ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি ’ তদন্তে সিনেটের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য ।
জনগণ ও সরকারের মধ্যে সংযোগ রক্ষা :
আইনসভা জনগণের সঙ্গে সরকারের সংযোগ রক্ষা করে । আইনসভার সদস্যরা নিজ নিজ এলাকার জনগণের দাবিদাওয়া , অভাব অভিযোগ ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় অধিবেশন চলাকালীন সভার মাধ্যমে সরকারের কাছে তুলে ধরেন । এ ছাড়া আইনসভায় সরকারি নীতি ও কর্মসূচির যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয় তা জনগণের কাছে তুলে ধরেন সদস্যরা । এভাবে আইনসভা জনগণ ও সরকারের মধ্যে সেতু রচনা করে ।
উপসংহার
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিতে তত্ত্বগতভাবে আইনসভার হাতে অধিক ক্ষমতা থাকলেও বাস্তবে কিন্তু শাসন বিভাগের কর্তৃত্ব ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে । দলীয় ব্যবস্থার প্রচলন , জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সমস্যার জটিলতা বৃদ্ধি ইত্যাদির ফলে শাসন বিভাগের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । তবু রাষ্ট্র পরিচালনায় আইনসভার গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না । গণতন্ত্রে আইনসভা হল একমাত্র প্রতিষ্ঠান যেখানে জনগণের মতামত অবাধে প্রকাশিত হওয়ার সুযোগ পায় ।