রাষ্ট্র বিজ্ঞান

উদারনীতিবাদ কাকে বলে

Contents

উদারনীতিবাদ কাকে বলে

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক আলোচনায় রাষ্ট্রের কার্যাবলি এবং প্রকৃতি সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ হল উদারনৈতিক মতবাদ । বস্তুত , রাষ্ট্রবিজ্ঞানে উদারনীতিবাদের সাধারণ অর্থ হল রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে ব্যক্তি স্বাধীনতার নীতি প্রতিষ্ঠা । 

এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা অনুযায়ী , উদারনীতিবাদ হল এমন এক ধারণা যা সরকারি কাজের নীতি ও পদ্ধতিরূপে , সমাজ গঠনের নীতিরূপে এবং ব্যক্তি ও সমাজের এক জীবনাদর্শরূপে ‘ স্বাধীনতা’কে প্রতিষ্ঠা করে । 

উদারনীতিবাদের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে সারতোরি বলেছেন , উদারনীতিবাদ হল এমন এক আদর্শ যা ব্যক্তিস্বাধীনতা , আইনি সংরক্ষণ ও সাংবিধানিক রাষ্ট্র কাঠামোর অনুসরণ করে । 

হ্যারল্ড ল্যাস্কি উদারনীতিবাদ বলতে স্বাধীনতার অনুশাসনকে বুঝিয়েছেন । ব্যক্তির চিন্তা , বিশ্বাস , মতপ্রকাশ ইত্যাদি ক্ষেত্রে উদারনীতিবাদ সর্বাধিক স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করতে চায় । 

উদারনীতিবাদ সংকীর্ণ ও ব্যাপক এই দুই অর্থেই ব্যবহৃত হয় । সংকীর্ণ অর্থে উদারনীতিবাদ বলতে এমন এক তত্ত্বকে বোঝায় যা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে । অর্থনৈতিক ক্ষেত্রকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাখা এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের শাসক  প্রতিনিধিদের নির্বাচন ও অপসারণের ব্যাপারে নাগরিকদের ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সর্বোচ্চ স্থানে প্রতিষ্ঠা করা সংকীর্ণ অর্থে উদারনীতিবাদের প্রধান উদ্দেশ্য । 

অন্যদিকে ব্যাপক অর্থে উদারনীতিবাদ হল এমন এক মানসিক ধারণা যা ব্যক্তির অধিকার , স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিত্বের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের পক্ষপাতী । বস্তুতপক্ষে সংকীর্ণ ও ব্যাপক উভয় ক্ষেত্রেই উদারনীতিবাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল স্বাধীনতা ।

উদারনীতিবাদের মূল নীতি

সামগ্রিকভাবে উদারনীতিবাদের বৈশিষ্ট্য বা মূলনীতি বা মূলসূত্রগুলি হল— 

আইনের শাসন : 

উদারনৈতিক মতবাদে আইনের শাসনের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয় । ব্যক্তির পৌর স্বাধীনতাকে রক্ষা করার জন্য আইনকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন বলে এই দর্শনের প্রবক্তারা মনে করেন । 

শাসিতের সম্মতি :

শাসিতের সম্মতির ওপর প্রতিষ্ঠিত সরকারকে উদারনৈতিক মতবাদে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয় । এজন্য সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্বমূলক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা হয় । 

অবাধ বাণিজ্য নীতি : 

উদারনৈতিক মতবাদ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবাধ বাণিজ্যের নীতিকে স্বীকার করে । অ্যাডাম স্মিথের মতে , অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবাধ প্রতিযোগিতার ফলে সমাজের সর্বাধিক কল্যাণ সাধিত হয় । 

স্বাধীনতা : 

উদারনৈতিক মতবাদে স্বাধীন চিন্তা , স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার মতো ব্যক্তিগত স্বাধীনতাগুলিকে অপরিহার্য বলে মনে করা হয় । এ ছাড়া জাতি-ধর্ম-বর্ণ এবং স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার কথাও বলা হয় । 

আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতা : 

জাতিগত সাম্য , আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার , আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্য এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শান্তি ও সহযোগিতাকে উদারনৈতিক মতবাদে স্থান দেওয়া হয়েছে । 

রাজনৈতিক সাম্য : 

আধুনিক উদারনৈতিক মতবাদে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয় । এজন্য জনগণের শাসন বা গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয় । জনগণের শাসন বলতে এখানে সংখ্যা গরিষ্ঠের শাসনকে বোঝায় । 

পৌর ও রাজনৈতিক অধিকারের স্বীকৃতি : 

উদারনৈতিক মতবাদে নাগরিকদের পৌর এবং রাজনৈতিক অধিকারগুলিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় । এর মধ্যে রয়েছে জীবনের অধিকার , চিন্তা ও মত প্রকাশের অধিকার , ধর্মের অধিকার , নির্বাচন করা ও নির্বাচিত হওয়ার অধিকার , পরিবার গঠনের অধিকার প্রভৃতি । 

সাংবিধানিক পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তন : 

উদারনৈতিক মতবাদে শান্তি পূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ কর্তৃক সরকারের পরিবর্তন স্বীকৃত হয়েছে । এজন্য বৈপ্লবিক ও হিংসাত্মক পথের প্রয়োজন হয় না । 

আইনের দৃষ্টিতে সাম্য : 

আইনের দৃষ্টিতে সমতা এবং আইনের দ্বারা সমানভাবে সংরক্ষিত হওয়ার বিষয়টি উদারনৈতিক মতবাদে স্বীকৃত হয়েছে । আইনের অনুশাসনের মাধ্যমে উদারনৈতিক গণতন্ত্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয় । 

স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা : 

উদারনৈতিক গণতন্ত্রে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলিকে সংরক্ষণ করে । এ ছাড়া আদালত এখানে দেশের সংবিধানের ব্যাখ্যা কর্তা ও অভিভাবক হিসেবে কাজ করে ।

প্রাপ্ত বয়স্কের ভোটাধিকার : 

উদারনৈতিক গণতন্ত্রে সার্বিক প্রাপ্ত বয়স্কের ভোটাধিকারকে সবচেয়ে বেশি । গুরুত্ব দেওয়া হয় । জাতি-ধর্ম , স্ত্রী-পুরুষ , ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের সমানভাবে ভোটদানের অধিকার স্বীকৃত হয় । 

জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রনীতি : 

আধুনিক বা সংশোধনমূলক উদারনৈতিক গণতন্ত্রে জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয় । সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে গতিশীল কর ব্যবস্থা , শিল্প-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ , ক্ষেত্র বিশেষে জাতীয়করণ প্রভৃতির কথাও বলা হয় । 

বহুদলীয় ব্যবস্থা : 

আধুনিক উদারনীতিবাদের প্রবক্তারা বহুদলীয় ব্যবস্থাকে রাষ্ট্রের পক্ষে আদর্শ বলে মনে করেন । তাঁদের মতে , জনগণের বহুমুখী আশা-আকাঙ্ক্ষার রূপায়ণ বহুদলীয় ব্যবস্থার মাধ্যমেই সম্ভব । 

ব্যক্তিগত সম্পত্তির স্বীকৃতি : 

উদারনীতিবাদী দার্শনিকরা ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারকে স্বীকৃতি দেন । তাঁদের মতে , নাগরিকদের হাতে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার না থাকলে তারা কাজকর্মে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে । ফলে দেশের সার্বিক উন্নয়ন ব্যাহত হবে । 

ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা : 

উদারনীতিবাদ ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণকারী রাষ্ট্র সর্বস্ব ফ্যাসিবাদের তীব্র বিরোধী । ফ্যাসিবাদী তত্ত্বের একদলীয় একনায়কের শাসন , ব্যক্তিপূজা , অগণতান্ত্রিক ও প্রতিক্রিয়াশীল কার্যকলাপ , জাতি বিদ্বেষ , আগ্রাসী যুদ্ধনীতি ইত্যাদিকে উদারনীতিবাদে কঠোর ভাষায় নিন্দা করা হয় । 

বহুত্ববাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা : 

উদারনীতিবাদ বহুত্ববাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতী । উদারনীতিবাদ বিশ্বাস করে , রাষ্ট্রের বদলে বহুত্ববাদী সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী নিজেদের পারস্পরিক আশা আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়িত করার সুযোগ পেতে পারে । 

ন্যূনতম রাষ্ট্র : 

নয়া উদারনীতিবাদে রাষ্ট্রের ভূমিকার পরিবর্তন ঘটানো হয় । অতি ক্ষমতাশালী ও আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বদলে এক ন্যূনতম রাষ্ট্র বা সীমিত রাষ্ট্রের ধারণাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয় । নয়া উদারনীতিবাদ অনুসারে নিরাপত্তা রক্ষা , ন্যায়বিচার এবং প্রতিরক্ষা ছাড়া রাষ্ট্রের আর কোনো কাজ থাকতে পারে না । 

পুঁজির বিশ্বায়ন : 

নয়া উদারনীতিবাদ সারা বিশ্ব জুড়ে পুঁজির অবাধ চলাচলের পক্ষপাতী । 

মুক্ত বাজার অর্থনীতি : 

নয়া উদারনীতিবাদে মুক্ত বাজার অর্থনীতিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় । 

উদারনীতিবাদের সমালোচনা 

উদারনীতিবাদ তত্ত্বটি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সমালোচিত হয়েছে— 

( 1 ) তত্ত্বটি অত্যন্ত নমনীয় এবং অস্পষ্ট বলে সমালোচকরা মনে করেন । রাষ্ট্র ও তার ভূমিকা , নাগরিকদের আনুগত্য , স্বাধীনতা প্রভৃতি প্রশ্নে উদারনৈতিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মতৈক্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি । 

( 2 ) উদারনৈতিক মতবাদে কিছু পরস্পর বিরোধী ধারণা লক্ষ করা যায় । যেমন — রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার ধারণা অনেকটা পরস্পর বিরোধী । 

( 3 ) উদারনৈতিক মতবাদকে রক্ষণশীল বলে সমালোচকরা আখ্যায়িত করেন । উদারনীতিবাদের চিন্তা নায়করা সমাজের আমূল পরিবর্তনের পক্ষপাতী নন । 

( 4 ) মার্কসবাদীরা বলেন , উদারনৈতিক রাষ্ট্র দর্শন হল বুর্জোয়া শ্রেণির রাষ্ট্রদর্শন । তাঁদের মতে জনকল্যাণকর রাষ্ট্র হল ‘ একচেটিয়া পুঁজিবাদের কার্যনির্বাহক কমিটি ‘ । 

( 5 ) উদারনীতিবাদে স্বাধীনতার যে ধারণা দেওয়া হয়েছে তাকে নেতিবাচক বলে অনেকে মনে করেন । রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব , নাগরিকদের অধিকার , আনুগত্য , সাম্য ইত্যাদি বিষয়ে এই তত্ত্বে কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না । এখানে স্বাধীনতা বলতে শুধুমাত্র ব্যক্তি স্বাধীনতাকে বোঝানো হয়েছে । তা ছাড়া উদারনৈতিক দর্শন স্বাধীনতা সম্পর্কে কোনো পরিণত তত্ত্বের জন্ম দিতে পারেনি । 

উপরি উক্ত সমালোচনা সত্ত্বেও এ কথা বলা যায় যে , রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক আলোচনায় উদারনীতিবাদের তাৎপর্য অনস্বীকার্য । আধুনিক যুগে মানবতাবাদী ধ্যানধারণার বিকাশে উদারনীতির আবেদন সুগভীর । এই মতবাদ রাষ্ট্রকে মধ্যযুগীয় অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিস্থিতি থেকে স্বচ্ছ চিন্তার গতিশীল সমাজে এক নতুন চেহারায় উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে ।

error: Content is protected !!