ভারতের নির্বাচন কমিশনের গঠন ও কার্যাবলী
Contents
ভারতের নির্বাচন কমিশনের গঠন ও কার্যাবলী
ভারতের নির্বাচন কমিশনের গঠন
সংসদীয় গণতান্ত্রিক কাঠামোয় নির্বাচন পরিচালনার প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল ও তাৎপর্যপূর্ণ । ভারতীয় সংবিধানের রচয়িতারা নির্বাচনি ব্যবস্থার গুরুত্ব উপলব্ধি করে একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন সংস্থার ওপর নির্বাচন পরিচালনার যাবতীয় দায়িত্ব অর্পণ করেন । এই সংস্থার নাম হল নির্বাচন কমিশন । এক্ষেত্রে ভারতীয় সংবিধান পরিষদ কানাডার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেছে ।
কমিশনার ও অন্য আধিকারিকদের নিয়োগ :
সংবিধানের ৩২৪ ( ১ ) নং ধারা অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের হাতে নির্বাচন পরিদর্শন , পরিচালন এবং নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে । সংবিধানের ৩২৪ ( ২ ) নং ধারায় বলা হয়েছে , নির্বাচন কমিশন একজন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য কমিশনার নিয়ে গঠিত হবে । অন্য কমিশনারদের সংখ্যা সম্বন্ধে সংবিধানে কিছু বলা হয়নি । রাষ্ট্রপতি অন্যান্য কমিশনারের সংখ্যা নির্ধারণ করেন । মুখ্য নির্বাচন কমিশনার এবং অন্য কমিশনারদের রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করে থাকেন । এ ছাড়া আঞ্চলিকভাবেও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করা হয় ।
প্রতিটি সাধারণ নির্বাচন ও উপনির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনকে সাহায্য করার জন্য কমিশনের সঙ্গে পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি ছয় মাসের কার্যকালের মেয়াদে আঞ্চলিক কমিশনারদের নিয়োগ করেন । নির্বাচন সংক্রান্ত অভিযোগ শোনা এবং তারপর তাৎক্ষণিক রায়দান করাও তাঁদের কাজ । বর্তমানে প্রতিটি রাজ্যে একজন মুখ্য নির্বাচনি আধিকারিক রয়েছেন ।
এ ছাড়া ১৯৬৬ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আইন অনুসারে প্রতি জেলায় একজন জেলা নির্বাচনি অফিসার নিয়োগেরও ব্যবস্থা রয়েছে । উপরন্তু নির্বাচন কমিশনের বিবিধ দায়িত্ব পালনের জন্য রাষ্ট্রপতি প্রয়োজন অনুসারে বিভিন্ন কর্মচারী নিয়োগ করেন ।
কমিশনের সদস্য সংখ্যা :
ভারতের এক সদস্য বিশিষ্ট নির্বাচন কমিশনকে ১ লা অক্টোবর ১৯৯৩ সালে রাষ্ট্রপতি এক অধ্যাদেশ জারি করে তিন সদস্য বিশিষ্ট নির্বাচন কমিশনে রূপান্তরিত করেন । মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের সহযোগী দুই কমিশনারকে সমমর্যাদা ও সমক্ষমতা সম্পন্ন বলে ঘোষণা করা হয় ।
সদস্যদের কার্যকাল ও পদচ্যূতি :
নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের চাকরির শর্তাদি স্থির করার দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির হাতে রয়েছে । অবশ্য এক্ষেত্রে সংসদ প্রণীত আইন অনুসারে রাষ্ট্রপতি ক্ষমতা প্রয়োগ করেন । বর্তমানে মুখ্য নির্বাচন কমিশনারসহ নব নিযুক্ত দুজন কমিশনারের কার্যকাল ছয় বছর রাখা হয়েছে । নির্বাচনি ব্যবস্থার নিরপেক্ষতার কথা ভেবে সংবিধানের ৩২৪ ( ৫ ) নং ধারায় মুখ্য নির্বাচনি কমিশনারের অপসারণের জন্য এক বিশেষ পদ্ধতির ( ইমপিচমেন্টের ) কথা বলা হয়েছে ।
প্রমাণিত অকর্মণ্যতা এবং অসদাচরণের অভিযোগক্রমে মুখ্য নির্বাচন কমিশনারকে সংসদের উভয় কক্ষের অধিকাংশ এবং উপস্থিত ও ভোটদানকারী দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থনে রাষ্ট্রপতি পদচ্যুত করতে পারেন । সংবিধানে আরও বলা হয়েছে যে , নির্বাচন কমিশনারের পদে নিয়োগ করার পর , তাঁর চাকরির শর্ত ইত্যাদি এমনভাবে পরিবর্তন করা যাবে না যা তাঁর স্বার্থের পরিপন্থী হয় ।
ভারতে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা ও কার্যাবলি
ভারতীয় সংবিধানের ৩২৪ ( ১ ) নং ধারা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় আইনসভা , রাজ্য আইনসভা , রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতির নির্বাচন সংক্রান্ত কাজকর্মের তত্ত্বাবধান , পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের যাবতীয় দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের হাতে দেওয়া হয়েছে । নির্বাচন কমিশন এই দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করার জন্য নিম্নলিখিত কার্যাবলি সম্পাদন করে থাকে—
ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও সংশোধন :
লোকসভা ও বিধানসভার প্রতিটি সাধারণ নির্বাচন ও উপনির্বাচনের প্রাক্কালে ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও সংশোধন নির্বাচন কমিশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ।
নির্বাচনি কর্মী নিয়োগ :
লোকসভা ও বিধানসভার নির্বাচনগুলি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য নির্বাচন কমিশন প্রয়োজনীয় সংখ্যক নির্বাচনি কর্মী নিয়োগের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যপালকে অনুরোধ করে থাকে ।
ভোটদাতাদের সচিত্র পরিচয় পত্র প্রদান :
ভোটদাতাদের সচিত্র পরিচয়পত্র তৈরি করা এবং সেগুলি যথাযথভাবে বিলি বণ্টন করা নির্বাচন কমিশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ।
নির্বাচনি প্রতীক বণ্টন :
নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলিকে নির্বাচনি প্রতীক বণ্টন করা এবং প্রতীক নিয়ে কোনো দলের মধ্যে বিরোধের নিষ্পত্তির ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের রয়েছে ।
দলীয় স্বীকৃতি প্রদান বা প্রত্যাহার :
প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে নির্বাচন কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী নথিভুক্ত হতে হয় । নির্ধারিত মান অনুসারে রাজনৈতিক দলগুলিকে জাতীয় , রাজ্য বা আঞ্চলিক এবং অন্যান্য স্বীকৃত দল এই তিন ভাগে ভাগ করা হয় । রাজনৈতিক দলের স্বীকৃতি প্রত্যাহার করে নেওয়ার ক্ষমতাও নির্বাচন কমিশনের হাতে রয়েছে ।
নির্বাচন বা উপনির্বাচনের দিন ঘোষণা :
প্রতিটি নির্বাচন বা উপনির্বাচনের দিনক্ষণ স্থির করা ও ঘোষণার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনারের ।
মনোনয়নপত্র পেশ ও নাম প্রত্যাহারের তারিখ ঘোষণা :
নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হওয়ার পর কমিশন প্রার্থীদের মনোনয়ন পত্র পেশ ও নাম প্রত্যাহারের তারিখ ঘোষণা করে থাকে । মনোনয়নপত্রগুলি পরীক্ষা করে দেখার পর বৈধ প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা নির্বাচন কমিশনের অন্যতম দায়িত্ব ।
নির্বাচনি আচরণবিধি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন :
সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন সুনিশ্চিত করার জন্য নির্বাচন কমিশন নির্বাচনি আচরণবিধি প্রণয়ন করে থাকে । এই আচরণবিধি যাতে যথাযথভাবে মেনে চলা হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখে কমিশন ।
নির্বাচনি পর্যবেক্ষক নিয়োগ :
নির্বাচন কমিশন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে নির্বাচনি পর্যবেক্ষক নিয়োগ করে থাকে ।
নির্বাচনি স্থগিত বা বাতিল ঘোষণা :
নির্বাচনি পর্যবেক্ষকদের রিপোর্ট অনুসারে কোনো কেন্দ্রে বুথ দখল , জাল ভোট প্রদান ইত্যাদি ঘটনা ঘটে থাকলে নির্বাচন কমিশন সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কেন্দ্র বা ভোট গ্রহণ কেন্দ্রের নির্বাচন স্থগিত বা বাতিল ঘোষণা করতে পারে । সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রে পুনর্নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করার ক্ষমতাও কমিশনের হাতে রয়েছে ।
ভোট গণনা ও ফলাফল প্রকাশ :
নির্বাচন শেষ হওয়ার পর ভোটগণনা ও ভোটের ফলাফল প্রকাশ এবং প্রতিটি নির্বাচন কেন্দ্র সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ভোটপ্রাপ্ত প্রার্থীকে নির্বাচিত হওয়ার শংসাপত্র প্রদান নির্বাচন কমিশনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ ।
পরামর্শদান :
সংসদের কোনো সদস্য বা রাজা আইনসভার কোনো সদস্যের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিলে রাষ্ট্রপতি অথবা রাজ্যপালকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে থাকে নির্বাচন কমিশন ।
রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচন :
রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতির নির্বাচন সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ করে কমিশন ।
কেন্দ্রীয় ও রাজ্য আইনসভার উচ্চকক্ষের নির্বাচন :
কেন্দ্রীয় আইনসভার উচ্চকক্ষ ( রাজ্যসভা ) এবং রাজা আইনসভার উচ্চকক্ষ ( বিধান পরিষদ ) এর সদস্য নির্বাচনের যাবতীয় ব্যবস্থা কমিশন করে ।
প্রার্থীদের নির্বচন ব্যয় পরীক্ষা :
নির্বাচনে যাঁরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তাঁদের নির্বাচনী ব্যয় পরীক্ষা করা কমিশনের কাজ ।