জাতীয় কংগ্রেসের সুরাট বিভাজন
Contents
জাতীয় কংগ্রেসের সুরাট বিভাজন
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বারাণসীতে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের অধিবেশন থেকেই নরমপন্থী ও চরমপন্থী বিভাজন স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করে । শেষপর্যন্ত ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের সুরাট অধিবেশনে এই বিভাজন চরম রূপ পায় । যার পরিণামরূপে জাতীয় কংগ্রেস চরমপন্থী ও নরমপন্থী এই দুই গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে যায় । সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সুরাট বিচ্ছেদ প্রসঙ্গে তার ‘ A Nation in Making ’ গ্রন্থে লিখেছেন— সুরাটের ঘটনার ফলে জাতীয় কংগ্রেসের ইতিহাসে এক স্মরণীয় অধ্যায়ের অবসান এবং এক নতুন যুগের সূচনা হয় ।

জাতীয় কংগ্রেসের সুরাট অধিবেশনের পটভূমি
জাতীয় কংগ্রেসের বারানসী অধিবেশন :
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে মডারেট বা নরমপন্থী নেতা গোপালকৃষ্ণ গোখলের সভাপতিত্বে বারাণসীতে জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতির ভাষণে গোখলে বঙ্গভঙ্গ ও সরকারি দমন নীতির বিরুদ্ধে সমালোচনা করেন যা চরমপন্থী মতাদর্শবাদীরা মেনে নেন। এরপর চরমপন্থীরা কংগ্রেসের নেতৃত্বে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দেয়ার প্রস্তাব রাখেন , কিন্তু তাদের সে প্রস্তাব খারিজ হয়। মডারেটগণ প্রিন্স অব ওয়েলস এর ভারত আগমনকে স্বাগত জানানোর প্রস্তাব নিলে চরমপন্থীরা এর বিরোধিতা করে।
জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশন :
কলকাতায় ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে নওরােজি বলেন — স্বরাজ লাভ জাতীয় কংগ্রেসের মূল উদ্দেশ্য । স্বরাজের ব্যাখ্যা ও প্রকৃত অর্থ নিয়ে চরমপন্থী ও নরমপন্থীদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয় । মডারেটরা স্বরাজ বলতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনস্থ স্বায়ত্তশাসনের অধিকারকে বােঝাতে চান। চরমপন্থীরা স্বরাজ বলতে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণমুক্ত পূর্ণ স্বাধীনতার কথাই বলেন ।
বিচ্ছেদ সম্পূর্ণ — সুরাট অধিবেশন :
১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে সুরাটে কংগ্রেসের অধিবেশনের সূচনাতেই সভাপতির পদকে কেন্দ্র করে বিবাদ শুরু হয় । ১৬০০ জন প্রতিনিধির উপস্থিতিতে চরমপন্থী গােষ্ঠী লালা লাজপত রায়কে সভাপতি করার প্রস্তাব রাখে । কিন্তু সুরেন্দ্রনাথ ও গােখলের অনুরােধে লাজপত রায় সভাপতির পদ থেকে সরে দাঁড়ালে রাসবিহারী ঘােষের সভাপতিত্বে সুরাট অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় । অধিবেশনে স্বরাজ , বয়কট প্রভৃতি বিষয়ে পূর্বেকার কলকাতা অধিবেশনে যেসব প্রস্তাবগুলি গৃহীত হয়েছিল সেগুলি পরিবর্তন করা নিয়ে তীব্র গােলযােগ বাঁধে , চরমপন্থীরা সভাকক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে যায় এবং পরে ‘ ভারতমাতা ‘ গােষ্ঠী নামে একটি সভা গড়ে তােলে । সম্পূর্ণ হয় নরমপন্থী ও চরমপন্থী বিভাজন ।
জাতীয় কংগ্রেসের সুরাট অধিবেশনের তাৎপর্য
কংগ্রেসের সুরাট বিচ্ছেদ জাতীয় রাজনীতিতে ছিল এক অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা —
প্রথমত , সুরাট বিচ্ছেদের ফলে কংগ্রেসের গােষ্ঠীদ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে চলে আসে এবং জনমানসে কংগ্রেস সংগঠনটির প্রতি বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় ।
দ্বিতীয়ত , সুচতুর ব্রিটিশ নরমপন্থীদের কাছে টেনে নিয়ে এবং চরমপন্থীদের দূরে সরিয়ে দিয়ে উভয় গােষ্ঠীর সম্পর্ককে আরও বিষিয়ে দেয় । বড়ােলাট মিন্টো ভারত – সচিব মর্লেকে লেখেন — কংগ্রেস – বিচ্ছেদ আমাদের পক্ষে এক বিরাট জয় ( ‘ The Congress Collapse ( at start ) was a great triumph for us ’ ) ।
তৃতীয়ত , সুরাট বিচ্ছেদের সুদূরপ্রসারী ফলাফল হিসেবে জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম পর্বের ( ১৮৮৫ খ্রি. — ১৯০৫ খ্রি. ) পর থেকে গান্ধি যুগের পূর্ব পর্যন্ত ভারতীয় জাতীয় রাজনীতিতে নরমপন্থীদের পরিবর্তে চরমপন্থীরাই মূল নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে ।
মন্তব্য
সুরাট বিচ্ছেদ সাময়িকভাবে হলেও ভারতের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান জাতীয় কংগ্রেসকে দুর্বল করে ফেলে । এর ফল স্বরূপ জাতীয় আন্দোলন গতিহীন হয়ে পড়ে । প্রায় নয় বছর পর মূলত গান্ধিজির উদ্যোগে ‘ লক্ষ্মৌ চুক্তি ’ র ( ১৯১৬ খ্রি. ) মাধ্যমে পুনরায় কংগ্রেসের নরমপন্থী ও চরমপন্থীদের মিলন ঘটে ।
Bye