ভারতীয় শাসন ব্যবস্থার প্রকৃতি
Contents
ভারতীয় শাসন ব্যবস্থার প্রকৃতি
গ্রেট ব্রিটেনের সংসদীয় শাসন ব্যবস্থাকে বিশ্বের যে দেশগুলি অনুসরণ করেছে তার মধ্যে ভারত অন্যতম । ভারতের সংবিধান পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে , ভারতের শাসন ব্যবস্থাকে সংসদীয় বা মন্ত্রী পরিষদ চালিত শাসন ব্যবস্থারূপে অভিহিত করার পক্ষে যথেষ্ট কারণ রয়েছে । সেই কারণগুলি হল—
নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধানের উপস্থিতি
সংসদীয় শাসন ব্যবস্থার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল নিয়মতান্ত্রিক বা নাম সর্বস্ব রাষ্ট্রপ্রধানের উপস্থিতি । তত্ত্বগতভাবে নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধান রাষ্ট্রের প্রধান হলেও কার্যত তিনি মন্ত্রীসভার পরামর্শ অনুসারে শাসনকাজ পরিচালনা করেন । তাঁর নামে শাসনকাজ পরিচালিত হলেও মন্ত্রীসভা হল দেশের প্রকৃত শাসক । ভারতে রাষ্ট্রপ্রধানরূপে রাষ্ট্রপতি এই ধরনের নিয়মতান্ত্রিক শাসকের ভূমিকাই পালন করেন ।
ভারতীয় সংবিধানের অন্যতম রূপকার ড. আম্বেদকরের মতে , ভারতীয় সংবিধানে রাষ্ট্রপতি ব্রিটিশ সংবিধানে রাজা বা রানির অনুরূপ মর্যাদা লাভ করে থাকেন ( ” Under the Constitution the President occupies the same position as the king under the English Constitution ” ) ।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি বর্জিত
সংসদীয় শাসন ব্যবস্থার পীঠভূমি গ্রেট ব্রিটেনের মতো ভারতেও ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি স্বীকৃত হয়নি । সংসদীয় শাসন ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল আইন বিভাগ , শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের পরস্পর নির্ভরশীল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক । এই ধরনের শাসন ব্যবস্থায় আইনসভায় যে দল সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করে সেই দলের নেতা বা নেত্রীরা মন্ত্রীসভা গঠন করে দেশ শাসন করেন ।
আবার বিচার বিভাগের দায়িত্বে যেসব বিচারপতিরা থাকেন তাঁদের নিয়োগতালিকা মন্ত্রীসভাই অনুমোদন করে । সংসদীয় ব্যবস্থার এই বৈশিষ্ট্য ভারতে পুরোপুরি অনুসৃত হয়েছে ।
মন্ত্রীসভা গঠনে আইনসভার ভূমিকা
সংসদীয় সরকারের একটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হল মন্ত্রীসভা গঠন করার ব্যাপারে আইনসভার নিম্নকক্ষের কার্যকরী ভূমিকা । ব্রিটেনে আইনসভার নিম্নকক্ষ কমন্সসভায় যে দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সেই দলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা মন্ত্রীসভা গঠন করেন । অনুরূপভাবে ভারতেও কেন্দ্রীয় আইনসভার নিম্নকক্ষ লোকসভায় যে দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে রাষ্ট্রপতি সেই দলের নেতা বা নেত্রীকে সরকার গঠনের জন্য আহ্বান জানান ।
বিরোধী দলের গুরুত্ব
সংসদীয় বা মন্ত্রীসভা চালিত সরকারের একটি মুখ্য বৈশিষ্ট্য হল শক্তিশালী বিরোধী দলের উপস্থিতি । সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দল না থাকলে গণতন্ত্র ব্যাহত হয় । বিরোধী দলই সরকারকে যথাযথভাবে দেশ শাসন করতে বাধ্য করে । বিরোধী দল কর্তৃক ক্ষমতাসীন সরকারের সমালোচনা সংসদীয় গণতন্ত্রের একটি স্তম্ভস্বরূপ । ভারতে সংসদীয় ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে শক্তিশালী বিরোধী দলের উপস্থিতি বিদ্যমান ।
মন্ত্রীসভার দায়বন্ধতা
সংসদ বা আইনসভার নিম্নকক্ষের কাছে মন্ত্রীসভার দায়বদ্ধতা ভারতের সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় পূর্ণভাবে অনুসৃত হয়েছে । ভারতীয় আইনসভার নিম্নকক্ষ লোকসভার কাছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা তার যাবতীয় কাজকর্মের জন্য দায়বদ্ধ থাকে । মন্ত্রীসভার এই দায়িত্বকে যৌথ দায়িত্ব বলা হয় । এই কারণে লোকসভায় কোনো মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব গৃহীত হলে সমগ্র মন্ত্রীসভা পদত্যাগে বাধ্য হয় । অঙ্গরাজ্যে সংসদীয় ব্যবস্থার প্রচলন ।
সংসদীয় শাসন ব্যবস্থার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য অনুসরণ করে ভারতে অঙ্গরাজ্যগুলিতেও সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা প্রচলিত হয়েছে । রাজ্যগুলিতে নিয়মতান্ত্রিক প্রধানের ভূমিকা পালন করেন রাজ্যপাল । রাজ্যের শাসনকাজ পরিচালনায় রাজ্যপাল রাজ্য মন্ত্রীসভার পরামর্শ অনুযায়ী চালিত হন । অন্যদিকে রাজ্য মন্ত্রীসভা আবার রাজ্য আইনসভার কাছে যাবতীয় কাজকর্মের জন্য দায়বদ্ধ থাকে । আইনসভার আস্থা হারালে মন্ত্রীসভা পদত্যাগে বাধ্য হয় ।
প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্ব
সংসদীয় শাসন ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্ব । ব্রিটিশ সংসদীয় ব্যবস্থার বিশেষজ্ঞরা প্রধানমন্ত্রীকে মন্ত্রীসভার সমপর্যায় ভুক্ত সহকর্মীদের মধ্যে অগ্রগণ্য ( First among the equals ) বলে অভিহিত করেছেন । ভারতেও অনুরূপ ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে । ভারতের সংসদীয় ব্যবস্থায় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বা জোটের নেতা বা নেত্রী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী সরকারের নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন ।
সিদ্ধান্তের গোপনীয়তা
মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্তের গোপনীয়তা রক্ষা সংসদীয় শাসনব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য । ব্রিটিশ সংসদীয় ব্যবস্থায় মন্ত্রীসভার বৈঠকের কার্যবিবরণী গোপন দলিল হিসেবে সংরক্ষণ করা হয় । ভারতীয় সংসদীয় ব্যবস্থাতেও মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্তের গোপনীয়তা রক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে ।
আইন বিভাগের কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ
সংসদীয় শাসন ব্যবস্থার রীতি অনুসরণ করে ভারতে আইনবিভাগ তথা সংসদের ওপর শাসনবিভাগ বা মন্ত্রীসভার আধিপত্য বজায় রয়েছে । আইন প্রণয়নের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা পার্লামেন্ট বা সংসদে এবং রাজ্য মন্ত্রীসভা অঙ্গরাজ্যগুলির আইনসভায় মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে ।
মূল্যায়ন
সমালোচকরা মনে করেন , ভারতে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের কিছু বৈশিষ্ট্যের সমন্বয় ঘটেছে । তাই তাঁরা ভারতকে পূর্ণাঙ্গ সংসদীয় ব্যবস্থার দেশ বলে অভিহিত করতে চাননি । যুক্তি হিসেবে সমালোচকরা রাষ্ট্রপতিকে পুরোপুরি নাম সর্বস্ব বলে মেনে নিতে রাজি নন ।
সম্প্রতি রাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা জারির বিষয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার দেওয়া পরামর্শ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রত্যাখ্যানের ঘটনা ( ১৯৯৭ সালে উত্তরপ্রদেশে কল্যাণ সিং সরকার এবং ১৯৯৮ সালে বিহারে রাবড়ি দেবীর সরকারকে বরখাস্ত করার বিষয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার সুপারিশ পুনর্বিবেচনার জন্য ফেরত পাঠানোর দৃষ্টান্ত ) , ত্রিশঙ্কু লোকসভায় একক বৃহত্তম দল বা জোটের নেতাকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা গঠনের আহ্বান জানানো , ২০০৬ সালে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার পাঠানো ‘ লাভজনক পদ বিলে ‘ স্বাক্ষর না দিয়ে বিলটিকে পুনর্বার বিবেচনার জন্য ফেরত পাঠানো ইত্যাদি দৃষ্টান্তের কথা তাঁরা তুলে ধরেন । তা ছাড়া বর্তমানে ভারতীয় সংসদের সার্বভৌমত্ব কার্যত মন্ত্রীসভার সার্বভৌমত্বে পরিণত হয়েছে বলে তাঁরা মনে করেন ।
পরিশেষে বলা যায় , ত্রুটি বিচ্যুতি সত্ত্বেও ভারতীয় শাসন ব্যবস্থা সংসদীয় শাসন ব্যবস্থার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ । শীর্ষ আদালত সুপ্রিমকোর্ট তার দেওয়া বিভিন্ন মামলার রায়ে ভারতে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থার অস্তিত্বের কথাই তুলে ধরেছে [ সামশের সিং বনাম পাঞ্জাব রাজ্য মামলা ( ১৯৭৪ ) ] ।