সংসদীয় সরকার ও রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের পার্থক্য 

Contents

সংসদীয় সরকার ও রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের পার্থক্য 

আধুনিক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রেক্ষিতে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা হয় । [ 1 ] রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন ব্যবস্থা ও [ 2 ] মন্ত্রী পরিষদ চালিত বা সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা ।

অধ্যাপক অ্যালান বলের মতে , রাজনৈতিক কাঠামোর ভিন্নতা হল এই শ্রেণি বিভাজনের মূল ভিত্তি । রাষ্ট্রপতি শাসিত এবং সংসদীয় শাসন ব্যবস্থার মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে সাদৃশ্য বর্তমান । যেমন , প্রকৃতিগতভাবে উভয় রাজনৈতিক ব্যবস্থাই হল গণতান্ত্রিক এবং দুটি ক্ষেত্রেই সরকার একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের ব্যবধানে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হয়ে থাকে । কিন্তু উভয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে সাদৃশ্যের চেয়ে পার্থক্য বেশি লক্ষ করা যায় । পার্থক্যগুলি হল— 

কাঠামোগত

কাঠামোগত দিক থেকে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে মন্ত্রীপরিষদ চালিত বা সংসদীয় শাসন ব্যবস্থার কিছু মৌলিক পার্থক্য দেখা যায় । সংসদীয় ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপ্রধান আইনসভার অবিচ্ছেদ্য অংশ । তিনি আইনসভার অধিবেশন আহ্বান করতে , স্থগিত রাখতে বা নিম্নকক্ষ ভেঙে দিতেও পারেন । আইনসভায় তাঁর ভাষণ দেওয়ার ক্ষমতাও রয়েছে । তাঁর অনুমতি ছাড়া আইনসভা কর্তৃক গৃহীত কোনো বিল আইনে পরিণত হতে পারে না । 

অন্যদিকে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি আইনসভার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচিত হন না । আইনসভার নিম্নকক্ষ ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা তাঁর নেই । আইনসভার অধিবেশন আহ্বান করতে বা স্থগিত রাখতেও তিনি পারেন না । তবে সংবিধান সংশোধনী বিল ছাড়া অন্যান্য প্রতিটি বিলের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন আবশ্যক হিসেবে গণ্য হয় । 

রাষ্ট্রপ্রধানের ক্ষমতাগত 

রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধান বা নামসর্বস্ব রাষ্ট্রপ্রধান নন । এই শাসন ব্যবস্থায় দেশের প্রকৃত রাষ্ট্রপ্রধান হলেন রাষ্ট্রপতি । তিনি রাষ্ট্র এবং শাসন বিভাগের প্রধান । তাঁর নামেই শাসন পরিচালিত হয় এবং প্রকৃতপক্ষে তিনিই শাসন করেন । 

অন্যদিকে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থার মুখ্য বৈশিষ্ট্য হল একজন নিয়মতান্ত্রিক বা নামসর্বস্ব শাসকের উপস্থিতি । এই ধরনের শাসন ব্যবস্থায় আইনগতভাবে দেশের চূড়ান্ত প্রশাসনিক ক্ষমতা নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধানের নামে পরিচালিত হলেও বাস্তবে তিনি শাসনকাজ পরিচালনা করেন না । বস্তুত তিনি রাষ্ট্রপ্রধান হলেও শাসন বিভাগের প্রধান নন । 

দায়বদ্ধতা সংক্রান্ত 

রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি প্রত্যক্ষভাবে জনসাধারণের দ্বারা নির্বাচিত হন । এই কারণে রাষ্ট্রপতি তাঁর সম্পাদিত কাজকর্মের জন্য একমাত্র জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকেন । অন্যদিকে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় সরকারি নীতি ও কাজকর্মের জন্য সমগ্র মন্ত্রীসভাকে ব্যক্তিগত ও যৌথভাবে আইনসভার কাছে দায়িত্বশীল থাকতে হয় । 

পদচ্যূতি সংক্রান্ত 

রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি আইনসভার কাছে দায়িত্বশীল নন বলে আইনসভায় অনাস্থা প্রস্তাব গৃহীত হলেও তাঁকে পদ থেকে অপসারণ করা যায় না । কেবলমায় সংবিধান ভঙ্গ , দেশদ্রোহিতা , দুর্নীতি প্রভৃতি গুরুতর অপরাধের জন্য আইনসভা রাষ্ট্রপতিকে তাঁর কার্যকালের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ‘ ইমপিচমেন্ট ‘ পদ্ধতিতে পদচ্যুত করতে পারে । 

অন্যদিকে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় মন্ত্রীসভাকে আইনসভার কাছে দায়িত্বশীল থাকতে হয় বলে আইনসভায় সংখ্যা গরিষ্ঠ সদস্যদের আস্থা হারালে মন্ত্রীসভাকে কার্যকাল শেষ হওয়ার আগেই পদত্যাগ করতে হয় । 

ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ সম্পর্কিত 

রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন ব্যবস্থা ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত । এখানে শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগ পরস্পরের নিয়ন্ত্রণ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে কাজ করে । 

অন্যদিকে , সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি অনুসৃত হয় না । এই ধরনের শাসন ব্যবস্থায় আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকে । 

মন্ত্রীসভার উৎকর্ষ সংক্রান্ত 

রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি তাঁর বিচার বিবেচনা অনুসারে সুযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে মন্ত্রীসভা গঠন করেন । এই মন্ত্রীসভা যথেষ্ট দক্ষতা ও যোগ্যতার সঙ্গে শাসনকার্য সম্পাদনে সক্ষম হয় । কিন্তু সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় মন্ত্রীসভার সদস্যদের নিয়োগের সময় প্রধানমন্ত্রীকে দলীয় নির্দেশের দিকে নজর রেখে চলতে হয় । এর ফলে অনেক সময়ে দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে মন্ত্রীসভা গঠন করা সম্ভব হয় না । 

জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত 

জরুরি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন ব্যবস্থা যেরকম উপযোগী , সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা তেমন নয় । সংসদীয় শাসন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে মন্ত্রীসভাকে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে হয় । তাই জরুরি অবস্থার মতো সংকটকালীন সময়ে অতি দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না । 

অন্যদিকে রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি দেশের সর্বোচ্চ শাসক হিসেবে স্বাধীনভাবে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন । 

মন্ত্রীপরিষদের পদমর্যাদা সম্পর্কিত 

সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় মন্ত্রীপরিষদ আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সদস্যদের নিয়ে গঠিত হয় । এই ধরনের শাসন ব্যবস্থায় মন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রীর সহকর্মী , তাঁরা তত্ত্বগতভাবে প্রধানমন্ত্রীর সমমর্যাদা সম্পন্ন হলেও প্রধানমন্ত্রী হলেন অগ্রগণ্য । 

অন্যদিকে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন ব্যবস্থাতেও একটি মন্ত্রীপরিষদের অস্তিত্ব রয়েছে । কিন্তু এই মন্ত্রীপরিষদের সদস্যরা রাষ্ট্রপতির সহকর্মী নন , তাঁরা রাষ্ট্রপতির অধস্তন কর্মচারীমাত্র । 

দলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা জনিত 

সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর দল আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ । বস্তুত দলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকলে প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রীসভা গঠন করতে পারেন না । কিন্তু রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি যে রাজনৈতিক দলের সদস্য সেই দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা আইনসভায় থাকতেও পারে , আবার নাও থাকতে পারে । 

স্থায়িত্বগত 

যে দেশে বহুদলীয় ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় ঘনঘন সরকার বদলের আশঙ্কা থাকে । কিন্তু রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের স্থায়িত্বের ব্যাপারে কোনো আশঙ্কা থাকে না । রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের স্থায়িত্ব সংসদীয় সরকারের স্থায়িত্বের চেয়ে অনেক বেশি সুনিশ্চিত । 

বিচার বিভাগীয় প্রাধান্য সংক্রান্ত 

রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থায় বিচার বিভাগের প্রাধান্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয় । অন্যদিকে সংসদীয় বা মন্ত্রীপরিষদ চালিত ব্যবস্থায় বিচার বিভাগের বদলে আইনসভার সার্বভৌমত্বকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয় । 

উপসংহার 

আধুনিক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সংসদীয় সরকার এবং রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের মধ্যে যে পার্থক্য দেখা যায় তা অনেকটা কাঠামোগত ও কার্যপ্রণালীগত পার্থক্য । দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ওপর এই দু ধরনের শাসন ব্যবস্থার সাফল্য নির্ভরশীল । 

error: Content is protected !!