রাষ্ট্র বিজ্ঞান

এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থার দোষ গুণ বা সুবিধা অসুবিধা

Contents

এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থার দোষ গুণ বা সুবিধা অসুবিধা

এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থার গুণ বা সুবিধা 

এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থার যেসব গুণ বা সুবিধার কথা বলা হয় তার মধ্যে নিম্নলিখিতগুলি উল্লেখযোগ্য— 

সরল ও দায়িত্বশীল প্রশাসন :

গার্নারের মতে , এককেন্দ্রিক সরকার সাংবিধানিক দিক থেকে অনেক সরল প্রকৃতির । এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থায় সারা দেশে একই ধরনের আইন চালু থাকায় প্রশাসনিক জটিলতা অপেক্ষাকৃত কম হয় । এ ছাড়া অন্যান্য শাসন ব্যবস্থার চেয়ে এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থায় অভিন্ন আইনের মাধ্যমে প্রশাসন পরিচালিত হওয়ায় এটি অনেক সুদৃঢ় হয় । সর্বোপরি এই ধরনের শাসন ব্যবস্থায় সমগ্র দেশের শাসনভার কেন্দ্রের ওপর ন্যস্ত থাকায় কেন্দ্র এই দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করতে পারে । 

জাতীয় সংহতির সহায়ক :

এককেন্দ্রিক শাসনে সারা দেশে একই আইন ও শাসন চালু থাকে বলে দেশের ঐক্য ও সংহতি সুনিশ্চিত হয় । নাগরিকরা শুধু কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি অনুগত থাকে । ফলে আঞ্চলিকতা , বিচ্ছিন্নতা প্রভৃতি সমস্যা থাকে না । 

প্রশাসনিক নমনীয়তা :

দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে প্রশাসনিক নমনীয়তা নিঃসন্দেহে এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থার একটি বিশেষ গুণ । কেন্দ্রীয় সরকার এখানে দরকার মতো আঞ্চলিক সরকার গড়ে তুলতে পারে এবং সেই সরকারের ক্ষমতার হ্রাস বৃদ্ধি ঘটাতে পারে । এর ফলে প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয় । 

মিতব্যয়ী প্রশাসন :

একটি মাত্র সরকার সমগ্র দেশের প্রশাসন পরিচালনা করে বলে এক্ষেত্রে প্রশাসনিক খরচ বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না । অধ্যাপক গার্নারের মতে , যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের চেয়ে এককেন্দ্রিক সরকার অনেকটাই কম ব্যয় সাপেক্ষ । 

ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের উপযোগী :

অনেকে মনে করেন , ছোটো ছোটো রাষ্ট্রের পক্ষে এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা বেশি উপযোগী । সাধারণত যে সমস্ত দেশে জনসমাজের মধ্যে জাতিগত ও সংস্কৃতিগত বৈচিত্র্য খুব বেশি নয় সেখানে এককেন্দ্রিক সরকারের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে । 

সংকট মোকাবিলায় দক্ষ :

এককেন্দ্রিক সরকার দেশের প্রশাসন পরিচালনায় দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে এবং তা রূপায়ণ করতে সক্ষম । এই কারণে এককেন্দ্রিক সরকার অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে জাতীয় সংকটজনিত পরিস্থিতির দ্রুত মোকাবিলা করতে পারে । 

সাংবিধানিক নমনীয়তা : 

এককেন্দ্রিক সরকারের সংবিধান নমনীয় বা সুপরিবর্তনীয় হওয়ার ফলে জাতীয় উন্নয়নের স্বার্থে যে কোনো প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা সহজ হয় । সরকার দ্রুত সংবিধান সংশোধন করে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে পারে । এছাড়া যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সংবিধানকে সহজে পরিবর্তন করা যায় । ফলে বিক্ষোভের সম্ভাবনা থাকে না ।

এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থার দোষ বা অসুবিধা 

এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থাও সম্পূর্ণ ত্রুটি মুক্ত নয় । এই ধরনের শাসনব্যবস্থার নিম্নলিখিত ত্রুটি বা অসুবিধার কথা বলা হয়— 

অগণতান্ত্রিক :

এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থার অন্যতম ত্রুটি হল স্বায়ত্ত শাসন ব্যবস্থার অনুপস্থিতি । এই শাসন ব্যবস্থায় সকল ক্ষমতার উৎস হল কেন্দ্রীয় সরকার । আঞ্চলিক সরকারগুলির কোনো স্বাধীন ও স্বতন্ত্র সত্তা নেই । তারা সব বিষয়ে কেন্দ্রের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় অনেকে এককেন্দ্রিক শাসনকে অগণতান্ত্রিক বলেন । 

সুশাসন ও বৃহৎ রাষ্ট্রের পক্ষে উপযোগী নয় :

সমগ্র দেশের জন্য একই আইনের মাধ্যমে একই ধরনের প্রশাসন পরিচালনা বৃহৎ আকারের রাষ্ট্রগুলিতে সুশাসনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় । কেননা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন সমস্যা কেন্দ্রীয়ভাবে বিচার বিবেচনা করা যায় না । এই কারণে বৃহৎ আকার , জনবহুল এবং ব্যাপক বৈচিত্র্য সম্পন্ন রাষ্ট্রের পক্ষে এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা উপযোগী নয় বলে মনে করা হয় । আধুনিক জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের পক্ষে এই শাসনব্যবস্থা সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে । 

আমলা নির্ভর :

সমগ্র দেশে একটিমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্যে প্রশাসন পরিচালনার সময় সরকারি আমলাদের ওপর নির্ভর করতে হয় । এতে আমলাদের ক্ষমতা বহুলাংশে বেড়ে যায় , যার ফলে শাসন ব্যবস্থা আমলাতান্ত্রিক হয়ে ওঠে । 

জাতীয় সংস্কৃতির পরিপন্থী :

এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থায় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র স্বার্থ সংরক্ষণে কোনো পৃথক ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয় না । এর ফলে সংখ্যালঘুদের মনে যে অসন্তোষ দেখা দেয় তা জাতীয় সংহতির বিরোধী হয়ে দাঁড়ায় । 

স্বৈরাচারের আশঙ্কা :

এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থায় স্বৈরাচারের আশঙ্কা দেখা দিতে পারে । এই ব্যবস্থায় শাসন ক্ষমতা অতিমাত্রায় কেন্দ্রীভূত হওয়ার কারণে ক্ষমতাসীন শাসক গোষ্ঠীর ক্ষমতা লোভী এবং স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার আশঙ্কা থাকে । 

রাজনৈতিক চেতনা বিকাশের পরিপন্থী :

এককেন্দ্রিক শাসনে স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা না থাকায় প্রশাসন পরিচালনায় জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণের সুযোগ কম । এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় দেশের রাজনৈতিক কার্যকলাপে জনগণের আগ্রহের অভাব লক্ষ করা যায় । এই অবস্থা জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা বিকাশের সহায়ক নয় । 

আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য বিকাশের পরিপন্থী :

এককেন্দ্রিক সরকারে সমগ্র দেশের জন্য এক ও অভিন্ন প্রশাসন থাকায় বিভিন্ন অঞ্চলের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুলি বিকাশে বাধাপ্রাপ্ত হয় । 

বিচ্ছিন্নতাবাদের আশঙ্কা : 

এককেন্দ্রিক সরকারের পক্ষে দেশের প্রতিটি অঞ্চলের প্রতি সমান নজর দেওয়া সম্ভব হয় না ; এর ফলে কোনো কোনো অঞ্চলের মানুষের দাবিদাওয়া উপেক্ষিত থেকে যায় । এই উপেক্ষার ফলে বঞ্চিত জনগণের মধ্যে যে ক্ষোভ তৈরি হয় তা থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদ জন্ম নিতে পারে বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মনে করেন । 

বহুত্ববাদের প্রতিবন্ধক : 

আধুনিক গণতন্ত্র বহু মত ও পথের আদর্শ সমন্বিত বহুত্ববাদে ( Pluralism ) বিশ্বাসী । বহুত্ববাদ অনুসারে ক্ষমতার একটিমাত্র কেন্দ্র থাকা ঠিক নয় , কারণ ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ গণতন্ত্রের পক্ষে শুভ নয় । বলাবাহুল্য , এককেন্দ্রিক সরকারে আধুনিক গণতন্ত্রের এই ধারণা বাস্তবায়িত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই । 

উপসংহার 

পরিশেষে বলা যায় , একই জাতি অধ্যুষিত ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের পক্ষে এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা বিশেষ কার্যকরী । কিন্তু বৃহদায়তন ও বহু ভাষাভাষী অধ্যুষিত বৈচিত্র্যময় দেশের পক্ষে এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা উপযোগী হয়ে উঠতে পারে না ।

error: Content is protected !!