যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার কাকে বলে
Contents
যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার কাকে বলে
ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের নীতির ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের উদ্ভব ঘটে । যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের সংজ্ঞা নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা সহমতে পৌঁছোতে পারেননি ।
মন্তেষ্কুর মতে , যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা হল এমন এক চুক্তি যার মাধ্যমে সমজাতীয় কয়েকটি রাষ্ট্র একটি বৃহৎ রাষ্ট্রের সদস্যরূপে অন্তর্ভুক্ত হয় ।
অধ্যাপক কে. সি. হোয়ার যুক্তরাষ্ট্রের একটি সহজবোধ্য সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন , যুক্তরাষ্ট্র বলতে সেই শাসনব্যবস্থাকে বোঝায় যেখানে সংবিধান কর্তৃক কেন্দ্রীয় সরকার ও আঞ্চলিক সরকারগুলির মধ্যে এমনভাবে ক্ষমতা বণ্টন করা হয় যাতে উভয় সরকার নিজ নিজ প্রশাসনিক এলাকায় স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে ।
যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে বার্চের দেওয়া সংজ্ঞাকে অনেকে অধিকতর গ্রহণযোগ্য বলে রায় দিয়েছেন । বার্চের মতে , যুক্তরাষ্ট্র হল সেই শাসনব্যবস্থা যেখানে যাবতীয় ক্ষমতা একটি কেন্দ্রীয় সরকার ও কয়েকটি আঞ্চলিক সরকারের মধ্যে এমনভাবে বণ্টিত হয় যাতে এই দু ধরনের সরকার পরস্পরের পরিপুরকরূপে কাজ করতে পারে এবং নিজেদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে উভয়েই প্রত্যক্ষভাবে জনগণকে শাসন করতে পারে ।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে , দুটি পদ্ধতিতে সাধারণত যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হয় । একটি হল বিভক্তিকরণের প্রক্রিয়া , যার মাধ্যমে কোনো এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে ভাগ হয়ে গিয়ে একটি যুক্তরাষ্ট্র গঠন করে । অন্যটি হল সংহতি সাধনের প্রক্রিয়া , যার মাধ্যমে কয়েকটি সার্বভৌম রাষ্ট্র একত্রিত হয়ে নিজেদের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র গঠন করে । যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের দৃষ্টান্ত হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র , ভারত প্রভৃতি দেশের কথা উল্লেখ করা যায় ।
যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য
যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার কয়েকটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে । সেই বৈশিষ্ট্যগুলি নিম্নরূপ
দুই ধরনের সরকার
যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল কেন্দ্রীয় সরকার এবং অঙ্গরাজ্যের সরকারগুলির উপস্থিতি । সমগ্র দেশের শাসনকাজ পরিচালনার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের । অন্যদিকে আঞ্চলিক এলাকার শাসনের দায়িত্ব থাকে রাজ্য সরকারগুলির ওপর ।
লিখিত ও দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান
যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারগুলির মধ্যে যেভাবে ক্ষমতা বণ্টিত হয় তা সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে লিখিত থাকে । ফলে দু ধরনের সরকারের নিজ নিজ ক্ষমতা ও এক্তিয়ার সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা তৈরি হয় । অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের সাফল্যের কারণে সংবিধান শুধুমাত্র লিখিত হলেই চলে না , তাকে একই সঙ্গে দুষ্পরিবর্তনীয় প্রকৃতিরও হতে হয় ।
যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতের উপস্থিতি
সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতকে বাদ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার কল্পনা করা যায় না । যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থায় কেন্দ্র ও অঙ্গরাজ্যগুলির মধ্যে ক্ষমতা সম্পর্কিত যে কোনো বিষয়ে বিরোধ দেখা দিলে তার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয় যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতে । কেন্দ্র ও অঙ্গরাজ্যগুলির সরকার যাতে সংবিধানকে মান্য করে চলে তা দেখার দায়িত্ব যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতের । কোনো সরকার যদি সংবিধান বিরোধী আইন , আদেশ বা নির্দেশ জারি করে তবে তা বাতিল করে দেওয়ার ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতের রয়েছে ।
সংবিধানের প্রাধান্য
যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থায় সংবিধান সব ক্ষমতার উৎস । দেশের সর্বোচ্চ আইন হল সাংবিধানিক আইন । সরকার প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি নির্বিশেষে সবাইকে সংবিধানের অধীনে থেকে কাজকর্ম করতে হয় । অর্থাৎ সংবিধানের প্রাধান্য এখানে সুস্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় ।
দ্বৈত নাগরিকত্ব
দ্বৈত নাগরিকত্ব বলতে বোঝায় একই সঙ্গে সমগ্র দেশের নাগরিকত্ব ও নিজ নিজ রাজ্যের নাগরিকত্ব । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই দ্বৈত নাগরিকত্ব চালু রয়েছে । অবশ্য বর্তমানে দ্বৈত নাগরিকত্বকে যুক্তরাষ্ট্রের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য বলে মনে করা হয় না ।
দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার অস্তিত্ব
দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভাকেও যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্যরূপে অভিহিত করা হয় । আইনসভার নিম্নকক্ষকে জনগণের প্রতিনিধিত্বমূলক কক্ষ বলা হয় । অন্যদিকে উচ্চকক্ষ হল অঙ্গরাজ্যগুলির প্রতিনিধিত্বমূলক কক্ষ । উচ্চকক্ষে ছোটো বড়ো নির্বিশেষে প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের সমসংখ্যক প্রতিনিধিত্বকে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম নীতি বলে মনে করা হয় ।
অঙ্গরাজ্যের স্বতন্ত্র সংবিধান
অঙ্গরাজ্যের জন্য স্বতন্ত্র সংবিধানের অস্তিত্বকে অনেকে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যরূপে আখ্যায়িত করেছেন । সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার জন্য একদিকে যেমন একটি জাতীয় সংবিধান থাকে , অন্যদিকে তেমনি জাতীয় সংবিধানকে অনুসরণ করে রাজ্যগুলিরও পৃথক সংবিধানের অস্তিত্ব থাকে । যেমন , মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অঙ্গরাজ্যগুলির নিজস্ব সংবিধান রয়েছে ।
যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার গুণাগুণ
যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার মৌলিক গুণ
যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা আধুনিক গণতান্ত্রিক বিশ্বে তার কিছু মৌলিক গুণের জন্য সমাদৃত হয়েছে । সেই গুণগুলি হল—
ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ :
যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রধান গুণ হল দেশের শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নীতি অনুসরণ । যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কেন্দ্র এবং অঙ্গরাজ্যগুলির সরকারের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টিত হওয়ার ফলে কোনো সরকারের কাছে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়ে থাকে না ।
জাতীয় ও আঞ্চলিক স্বার্থের সমন্বয় :
যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় জাতীয় ও আঞ্চলিক স্বার্থের সার্থক সমন্বয় ঘটে । ভাষা ধর্ম বর্ণ সংস্কৃতির বৈচিত্র্য সংবলিত বিস্তৃত অঞ্চল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হয় । নিজেদের আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় অঙ্গরাজ্যের সরকারগুলি গড়ে ওঠে । অন্যদিকে বৈচিত্র্যের মধ্যে যে ঐক্য ও জাতীয়তাবোধ , তাই নিয়ে গড়ে ওঠে জাতীয় সরকার ।
স্বৈরাচার প্রতিরোধ :
একটি দুষ্পরিবর্তনীয় লিখিত সংবিধান কর্তৃক যাবতীয় শাসন ক্ষমতা কেন্দ্র ও অঙ্গরাজ্যগুলির মধ্যে বণ্টিত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় স্বৈরাচারের আশঙ্কা দূর হয় বলে অনেকে মনে করেন ।
অধিকতর গণতন্ত্র সম্মত :
অনেকে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থাকে অনেক বেশি গণতন্ত্র সম্মত বলে রায় দিয়েছেন । এখানে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ নীতিকে বাস্তবায়িত করা যায় বলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শাসনকাজে অধিক সংখ্যক জনগণের অংশ নেওয়া সম্ভব হয় । এর ফলে গণ অসন্তোষ বা বিদ্রোহের আশঙ্কা হ্রাস পায় ।
রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ :
যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থায় আঞ্চলিক স্তরে স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলিতে জনগণের ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে । এর ফলে জনগণের রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটে ।
অন্যান্য গুণ
যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সমগ্র দেশের প্রশাসন কেন্দ্র ও অঙ্গরাজ্যগুলির জনপ্রতিনিধিদের হাতে ন্যস্ত থাকে বলে আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্ব হ্রাস পায় । সংবিধানে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির ক্ষমতা বণ্টনের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ থাকে বলে উভয় সরকারের পক্ষে নিজেদের নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে স্ব স্ব ক্ষেত্রে সুষ্ঠুভাবে প্রশাসনিক কাজকর্ম পরিচালনা করা সম্ভব হয় । এর ফলে প্রশাসনিক উৎকর্ষ ও দক্ষতার বৃদ্ধি ঘটে । আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্য ও আঞ্চলিক স্বার্থের দাবিগুলি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় উপেক্ষিত হয় না বলে বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথা চাড়া দিতে পারে না ।