নাগরিকদের মৌলিক কর্তব্য
Contents
নাগরিকদের মৌলিক কর্তব্য
নিজের ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য অধিকার ভোগের বিনিময়ে নাগরিকদের যেসব দায়দায়িত্ব পালন করতে হয় সেগুলিকে কর্তব্য বলা হয় । অধিকার ভোগের শর্ত হল কর্তব্য পালন । কর্তব্য পালন ছাড়া অধিকার ভোগ করা যায় না । অনেকে মনে করেন সমষ্টিগত কল্যাণ সাধনের জন্য নাগরিকদের যেসব দায়দায়িত্ব পালন করতে হয় তাই হল কর্তব্য ।
সাধারণত নাগরিক কর্তব্যকে প্রকৃতি অনুযায়ী দুটি ভাগে ভাগ করা যায় ; একটি হল নৈতিক কর্তব্য এবং অন্যটি হল আইনগত কর্তব্য । নৈতিক কর্তব্যের সঙ্গে নীতিবোধ জড়িত থাকে । নৈতিক কর্তব্যে অবহেলা করলে রাষ্ট্রের কিছু করার থাকে না । অন্যদিকে আইনগত কর্তব্যের সঙ্গে আইনের অনুমোদন জড়িয়ে থাকে । তাই আইনগত কর্তব্যে অবহেলা করলে রাষ্ট্রের শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে ।
সামাজিক অধিকার , ব্যক্তিগত অধিকার এবং আইনগত অধিকার ভোগের নিরিখে নাগরিকদের কর্তব্যকে সামাজিক কর্তব্য , ব্যক্তিগত কর্তব্য এবং আইনগত কর্তব্য — এই তিনভাগে ভাগ করা হয় ।
সামাজিক কর্তব্য
মানুষ সামাজিক জীব । সামাজিক জীব হিসেবে সে যেসব অধিকার ভোগ করে সেগুলিকে সামাজিক অধিকার বলে । সামাজিক অধিকার ভোগ করতে গেলে ব্যক্তিকে সমাজের প্রতি কিছু দায়দায়িত্বও পালন করতে হয় । সমাজের প্রতি কোনোরকম দায়িত্ব পালন না করে কোনো ব্যক্তি তার সামাজিক অধিকার দাবি করতে পারে না । ল্যাস্কির মতে , আমাদের অধিকার শুধু সমাজ থেকে নেওয়ার জন্য নয় , সমাজকে দেওয়ার জন্যও ।
ব্যক্তিগত কর্তব্য
নাগরিকরা নিজেদের ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য যেসব ব্যক্তিগত অধিকার ভোগ করে থাকে তার বিনিময়ে কিছু ব্যক্তিগত কর্তব্য পালন করতে হয় । অর্থাৎ , ব্যক্তি হিসেবে যে অধিকার সে ভোগ করে তা যাতে অন্যেরাও ভোগ করতে পারে সেই সুযোগ করে দেওয়া তার কর্তব্য । অধ্যাপক হবহাউসের মতে , ধাক্কা না খেয়ে পথ চলার অধিকার যদি কারোর থাকে , তাহলে অন্যের কর্তব্য হল সেই ব্যক্তির প্রয়োজন অনুসারে পথ ছেড়ে দেওয়া ।
আইনগত কর্তব্য
রাষ্ট্র নাগরিকদের যেসব অধিকারকে যথাযথভাবে সংরক্ষিত করে স্বীকৃতি দেয় সেগুলিকে আইনগত অধিকার বলে । এই আইনগত অধিকারগুলি নাগরিকরা বিনা শর্তে ভোগ করতে পারে না , এজন্য তাদেরও রাষ্ট্রের প্রতি কিছু দায়দায়িত্ব পালন করে চলতে হয় । একেই আইনগত কর্তব্য বলে । রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকদের এইসব কর্তব্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—
আনুগত্য :
রাষ্ট্রীয় আদর্শ অনুসরণ , রাষ্ট্রীয় আইনকানুন মেনে চলা , রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ব্রতী থাকা , রাষ্ট্র প্রাধান্যকে মেনে নেওয়া , রাষ্ট্রীয় কাজকর্মে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করা ইত্যাদি কর্তব্যপালনের মাধ্যমে আনুগত্য প্রদর্শিত হয় । রাষ্ট্রের প্রতি এই আনুগত্য প্রদর্শন করা হল নাগরিকদের প্রাথমিক কর্তব্য ।
আইনের প্রতি মান্যতা :
আইন অমান্য করলে অরাজকতার আশঙ্কা দেখা দেয় , যা কখনোই রাষ্ট্রীয় জীবনে কাম্য নয় । এজন্য প্রতিটি নাগরিকের রাষ্ট্রীয় আইন সুষ্ঠুভাবে মেনে চলা উচিত । তবে রাষ্ট্রীয় আইন জনকল্যাণ বিরোধী হলে বা মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করলে তার প্রতিরোধ করা নাগরিকদের কর্তব্য বলে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রায় দিয়েছেন ।
কর প্রদান :
এটি আইনগত কর্তব্যের পর্যায়ে পড়ে । কর আদায় না হলে রাষ্ট্রের উন্নয়নের কাজকর্ম ব্যাহত হয় । এই কারণে কর দেওয়া প্রতিটি নাগরিকের অবশ্য পালনীয় কর্তনা । এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নির্ধারিত কর ঠিক সময়ে জমা দেওয়া এবং কর ফাঁকি না দেওয়ার বিষয়টি নাগরিকদের মেনে চলা উচিত ।
ভোটাধিকার যথাযথ প্রয়োগ :
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ভোটাধিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অধিকার । তাই , নাগরিকের কর্তব্য হল নিজের বিচার বুদ্ধি অনুসারে সৎভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করা । তবে এক্ষেত্রে রাষ্ট্রেরও কিছু দায়দায়িত্ব আছে । রাষ্ট্র যদি সুষ্ঠু ভোটাধিকার প্রয়োগের যোগ্য পরিবেশ গড়ে তুলতে না পারে তাহলে নাগরিকদের পক্ষে এই কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করা সম্ভব হয় না ।
অন্যান্য কর্তব্য :
নাগরিকদের রাষ্ট্রের প্রতি আরও কিছু কর্তব্য রয়েছে । এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল — উন্নত সমাজ গঠনে সচেষ্ট হওয়া , জনস্বাস্থ্য বজায় রাখা , প্রয়োজনে রাষ্ট্রের আহ্বানে দেশসেবার যে কোনো কাজে আত্মনিয়োগ করা ইত্যাদি ।
উপসংহার
রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্য পালন না করলে নাগরিকরা যেমন আইনগত অধিকার ভোগ করতে পারে না , ঠিক তেমন রাষ্ট্রেরও নাগরিকদের প্রতি কর্তব্য আছে । বস্তুত , নাগরিক অধিকারগুলি বাস্তবে যথাযথভাবে কার্যকর করা রাষ্ট্রের প্রধান কর্তব্য । অনেকে মনে করেন , রাষ্ট্র এক্ষেত্রে শৈথিল্য দেখাতে পারে না , কারণ সেক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে নাগরিকরাও রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্য পালনে অবহেলা করতে পারে ।