অধিকার ও কর্তব্যের মধ্যে সম্পর্ক
Contents
অধিকার ও কর্তব্যের মধ্যে সম্পর্ক
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় অধিকার ও কর্তব্যের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । কর্তব্যহীন অধিকার বলে কিছু থাকতে পারে না । অনুরূপভাবে অধিকারহীন কর্তব্যও কাম্য নয় । রাষ্ট্র ব্যবস্থায় উভয়ই একান্ত অপরিহার্য । অধিকার ও কর্তব্যের পারস্পরিক সম্পর্কের প্রধান দিকগুলি হল—
পরস্পর অঙ্গাঙ্গি
অধিকার ও কর্তব্য পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত । অধিকারের মধ্যেই কর্তব্য নিহিত রয়েছে । বস্তুতপক্ষে অধিকার ও কর্তব্য হল একই মুদ্রার দুটি দিক । সমাজবোধের ধারণা থেকেই অধিকার ও কর্তব্য উভয়ের সৃষ্টি । সমাজবদ্ধ মানুষের দাবিগুলি রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত হওয়ার পর অধিকারে রূপান্তরিত হয় । এই দাবিগুলি স্বীকার করার সঙ্গে কয়েকটি দায়িত্বপালনের অঙ্গীকার জড়িত থাকে । এগুলি কর্তব্য হিসেবে পরিচিত ।
পরস্পর নির্ভরশীল
অধ্যাপক হ্যারল্ড ল্যাস্কির মতে , যে কর্তব্য পালন করবে না সে অধিকার ভোগ করতে পারবে না । তাই এটা বলা যায় যে , একজনের অধিকারভোগ অন্যদের কর্তব্য পালনের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল । অধ্যাপক হবহাউস এর মতে , ধাক্কা না খেয়ে পথ চলার অধিকার যদি কারোর থাকে তাহলে অন্যের কর্তব্য হল সেই ব্যক্তির প্রয়োজন অনুসারে পথ ছেড়ে দেওয়া ।
অধিকারের ভিত্তি কর্তব্য
সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্যকে অধিকারের ভিত্তি হিসেবে অভিহিত করা হয় । হবহাউস এর বক্তব্য হল , সামাজিক দায়িত্ব পালনের শর্তে অধিকারভোগ সম্ভব । সমাজ ব্যক্তিকে অধিকার দেয় যাতে সে তার ব্যক্তিত্বের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের মাধ্যমে নিজেকে সমাজকল্যাণে নিয়োজিত করতে পারে ।
হ্যারল্ড ল্যাস্কির মতে , আমাদের অধিকার সমাজ থেকে শুধু নেওয়ার জন্য নয় , সমাজকে কিছু দেওয়ার জন্যও । বেন ও পিটারস উল্লেখ করেছেন , কর্তব্য পালনের ওপর অধিকারভোগ নির্ভরশীল । এদিক থেকে বিচার করে অধিকার ও কর্তব্য উভয়কেই সামাজিক ধারণা বলে অভিহিত করা হয় ।
কর্তব্যহীন অধিকার অসম্ভব
অধিকারের উৎস হল রাষ্ট্র । রাষ্ট্র অধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে তাকে যথাযথ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে । এ হল রাষ্ট্রের কর্তব্য । ঠিক তেমনি নাগরিকদেরও রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্য রয়েছে , যেমন নিয়মিত কর প্রদান , আনুগত্য প্রদর্শন , রাষ্ট্রীয় আইনকানুন মান্য করা প্রভৃতি । নাগরিকরা এসব কর্তব্য পালন না করলে রাষ্ট্রযন্ত্র অচল হয়ে পড়ে । আর রাষ্ট্রহীন সমাজে অধিকার বলে কিছু থাকে না । কাজেই রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্য পালন না করে নাগরিকরা অধিকার আশা করতে পারে না । তেমনি আবার রাষ্ট্র তার কর্তব্য পালন না করে নাগরিকদের কাছে কোনো কর্তব্য পালন আশা করতে পারে না ।
কোনো রাষ্ট্র নাগরিক অধিকারগুলির যথাযথ সংরক্ষণ না করলে নাগরিকরা স্বভাবতই কর্তব্যপালনে শৈথিল্য দেখাতে পারে , এমনকি তারা শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহও করতে পারে । অনেক স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রে অধিকার পদদলিত হয়েছে বলে জনগণ স্বাধিকার অর্জনের সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছে । এজন্য বলা হয় যে , রাষ্ট্র ও নাগরিক পরস্পরের প্রতি নিজেদের কর্তব্য সুষ্ঠুভাবে পালন করলেই একটি আদর্শ সমাজের ভিত্তি রচিত হতে পারে ।
অধিকার কর্তব্য দ্বারা সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত
অধিকার অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত হতে পারে না । সীমাহীন অধিকার স্বেচ্ছাচার ছাড়া আর কিছু নয় । অধিকার অবাধ হলে দুর্বলশ্রেণি সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারে । তাই অধিকারের পরিধিকে সীমিত রাখতে হয় । বস্তুতপক্ষে , অধিকারের পরিধি কর্তব্যবোধের দ্বারা সীমিত ।
নৈতিক অধিকার ও নৈতিক কর্তব্যবোধের মধ্যে অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক রয়েছে । বার্ধক্যে অক্ষম মাতা পিতা সন্তানের দ্বারা প্রতিপালিত হওয়ার নৈতিক অধিকার দাবি করতে পারে ; সেক্ষেত্রে সন্তানের কর্তব্য হল বৃদ্ধ পিতা মাতার সেবা যত্ন করা । তেমনই আবার সন্তানের শৈশবকালে তার উপযুক্ত লালন পালন ও শিক্ষার ব্যবস্থা করাও পিতা মাতার কর্তব্য । এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে , গণসাধারণতন্ত্রী চিনের সংবিধানের ৪৯ নং ধারায় এই নৈতিক অধিকার ও কর্তব্যের উল্লেখ করা হয়েছে ।
কর্তব্য পালনের যোগ্যতা ও অধিকার
অনেকে মনে করেন , সুষ্ঠুভাবে কর্তব্য পালনের জন্য অধিকার প্রয়োজন । পরিবার , সমাজ এবং রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের যে নানা ধরনের কর্তব্য থাকে তা যথাযথভাবে পালনের জন্য গুণগত যোগ্যতার প্রয়োজন । মানুষের অন্তর্নিহিত গুণাবলির পূর্ণবিকাশ এজন্য জরুরি । কাজেই অধিকারভোগের ভিত্তিতেই কর্তব্য পালনের যোগ্যতা সৃষ্টি হয় ।
ব্যক্তিস্বার্থ ও সামাজিক স্বার্থের সমন্বয় সাধন
কেবলমাত্র ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য কোনো নাগরিক অধিকার ভোগ করতে পারে না । সমাজ কল্যাণের বিরুদ্ধে যেতে পারে এমন কোনো অধিকার থাকতে পারে না । বস্তুত অধিকার এমনভাবে ভোগ করতে হয় যাতে ব্যক্তিগত স্বার্থ ও সামাজিক স্বার্থের মধ্যে সমন্বয় সাধন সম্ভব হয় । প্রতিটি অধিকারের সঙ্গে ব্যক্তিগত কল্যাণ এবং সামাজিক কল্যাণের সমন্বয়ের ধারণা জড়িত । সমাজের সাধারণ স্বার্থ সম্পর্কে সচেতনতা না থাকলে অধিকার ভোগ করা যায় না । আর এই সাধারণ সামাজিক স্বার্থ সম্পর্কে সচেতনতাই ব্যক্তিকে কর্তব্য পালনে উদ্বুদ্ধ করে ।
উপসংহার
অধিকার ও কর্তব্য আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য উপাদান । অর্থাৎ , অধিকারকে বাদ দিয়ে কর্তব্য বা কর্তব্যকে বাদ দিয়ে অধিকারের ধারণা ও প্রয়োগ পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে না । বস্তুত এই দুটি উপাদান পরস্পরের পরিপূরক ।