একনায়কতন্ত্রের সুবিধা ও অসুবিধা
Contents
একনায়কতন্ত্রের সুবিধা ও অসুবিধা
গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত শাসনব্যবস্থা হল একনায়কতন্ত্র । এর দোষ গুণগুলি নিম্নরূপ —
একনায়কতন্ত্রের সুবিধা
একনায়কতন্ত্রের যেসব গুণ বা সুবিধার কথা বলা হয় তার মধ্যে নিম্নলিখিতগুলি উল্লেখযোগ্য —
দলীয় প্রথার কুফল মুক্ত :
দলীয় প্রথার কুফল থেকে মুক্ত হওয়ায় একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শাসন কাজে শৃঙ্খলা এবং উৎকর্ষ বৃদ্ধি পায় । একনায়ক নিজে দক্ষতা ও দৃঢ়তার সঙ্গে প্রশাসন পরিচালনা করতে পারেন । একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দলীয় সংঘর্ষ , দল ব্যবস্থার জন্য অর্থের অপচয় , রাজনীতিতে অযোগ্য ব্যক্তির উত্থান ইত্যাদি কিছুই হয় না । অনেকে মনে করেন , একনায়কতন্ত্রে জ্ঞানীগুণী ও যোগ্য ব্যক্তিদের মর্যাদা দেওয়া হয় । দলীয় আনুকূল্য বিতরণ প্রথা একনায়কতন্ত্রে না থাকায় যোগ্য ব্যক্তিরা সমাদর পান ।
সরকারের স্থায়িত্ব :
একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থা সরকারের স্থায়িত্ব বজায় রাখার পক্ষে অনুকূল । জনমতের পরিবর্তনের কারণে ঘন ঘন সরকার পরিবর্তনের ঘটনা এখানে ঘটতে দেখা যায় না । ফলে সরকারী নীতি ও পরিকল্পনা রূপায়নে সমস্যা দেখা যায় না ।
জরুরি অবস্থার উপযোগী :
যুদ্ধ , বহিরাক্রমণ বা অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার মতো গুরুতর জরুরি পরিস্থিতির সন্তোষজনক দ্রুত সমাধান একমাত্র একনায়কতন্ত্রেই সম্ভব । এখানে একজন মাত্র ব্যক্তি অর্থাৎ একনায়কের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ায় সিদ্ধান্ত নিতে বিন্দুমাত্র দেরি হয় না ।
জাতীয় সংহতি ও দেশপ্রেমের পক্ষে অনুকূল :
একনায়কতন্ত্রে এক জাতি , এক রাষ্ট্র , একনায়ক থাকায় এক ধরনের জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের নীতি প্রতিফলিত হয় , যা জাতীয় সংহতিকে সুদৃঢ় করে । এইভাবেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে হিটলার জার্মান জাতিকে জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন ।
স্বচ্ছ ও সুদক্ষ প্রশাসনের উপস্থিতি :
আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা কঠোর হওয়ায় একনায়কতন্ত্রে প্রশাসনিক দুর্নীতির কোনো আশঙ্কা থাকে না । তা ছাড়া , একনায়ক নিজে দক্ষ ও সুযোগ্য হলে এবং তাঁর পছন্দ অনুযায়ী যোগ্য ব্যক্তিদের প্রশাসনের উচ্চস্তরে নিয়োগ করলে সুদক্ষ প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে ।
দ্ৰুত কর্মসূচি রূপায়ণ সম্ভব :
একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেহেতু সমগ্র দেশের শাসন সংক্রান্ত নীতি নির্ধারণ ও রূপায়ণের ভার একজন মাত্র ব্যক্তির হাতে ন্যস্ত থাকে তাই সরকারি কর্মসূচির দ্রুত রূপায়ণ এখানে সম্ভব হয় ।
দ্রুত আইন প্রণয়ন সম্ভব :
একনায়কতন্ত্রে আইন প্রণয়নের ব্যাপারে যাবতীয় জটিলতা এড়ানো যায় । কোনো জটিল পদ্ধতি এখানে অবলম্বন করতে হয় না । একনায়কের ইচ্ছা অনুযায়ী অতি দ্রুত দেশের কল্যাণে আইন প্রণীত হয় । শুধু আইন প্রণয়নের ব্যাপারে নয় , আইন কার্যকরী করার ব্যাপারেও সুদৃঢ় একনায়কতান্ত্রিক প্রশাসন অনেক বেশি উপযোগী হয়ে ওঠে ।
অর্থের অপচয় রোধ সম্ভব :
একনায়কতন্ত্রে ঘন ঘন নির্বাচনের প্রয়োজন হয় না বলে বিপুল পরিমাণ অর্থের অপচয় হয় না । আইন প্রণয়ন থেকে শুরু করে আরও অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রশাসনিক জটিলতার কোনো অস্তিত্ব না থাকায় সরকারি অর্থের অপচয় হওয়ারও আশঙ্কা থাকে না ।
একনায়কতন্ত্রের অসুবিধা
একনায়কতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থারও কিছু অসুবিধা বা ত্রুটি রয়েছে । সংক্ষেপে সেগুলি এইরকম 一
এই ধরনের শাসনব্যবস্থা ন্যায় ও সত্যের ন্যায় ও সত্যের বিরোধী :
একনায়কতন্ত্রের প্রধান ত্রুটি বিরোধী । জনগণের মতামতের ওপরে স্বৈরাচারী একনায়কের মতামত চাপিয়ে দেওয়া হয় বলে এখানে ন্যায় বা সত্যের প্রতিষ্ঠা ঘটে না ।
ব্যক্তি স্বাধীনতার বিরোধী :
একনায়কতন্ত্রে সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোনোরকম সমালোচনা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ থাকে । নাগরিকরা স্বাধীন মত প্রকাশের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয় বলে এখানে স্বাধীন ব্যক্তিসত্তার অপমৃত্যু হয় ।
স্বায়ত্ত শাসনের অন্তরায় :
একনায়কতন্ত্রে জনগণের স্বশাসনের কোনোরকম সুযোগ নেই । শাসনব্যবস্থার সর্বস্তরে একনায়কের প্রাধান্য প্রবলভাবে বজায় থাকে । এর ফলে এখানে কোনোভাবেই জনগণের পক্ষে শাসনকাজে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয় না ।
ব্যক্তি সত্তার বিরোধী :
একনায়কতন্ত্রে ব্যক্তির চেয়ে রাষ্ট্রকে বড়ো করে দেখা হয় । যার ফলে রাষ্ট্রীয় যুপকাষ্ঠে ব্যক্তিসত্তার বলিদান ঘটে ।
যুদ্ধবাদের পৃষ্ঠপোষক :
একনায়কতন্ত্রে জনগণের সম্মতির পরিবর্তে নায়কের পশুবল শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করে । এর ফলে উগ্র জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি হয় , যা পরোক্ষভাবে যুদ্ধবাদে রূপান্তরিত হয় । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে হিটলারের জার্মানি এর একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত ।
নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী :
একনায়কতন্ত্রে সবসময় নৈরাজ্যের প্রবল আশঙ্কা থাকে । সমস্ত ক্ষেত্রে জনগণ বঞ্চনার শিকার হয় বলে এই ধরনের শাসন ব্যবস্থায় জন বিক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয় । এই পুঞ্জীভূত ক্ষোভ পরবর্তী সময়ে দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করে ।
রাজনৈতিক চেতনা বিকাশের পরিপন্থী :
জাতীয় জীবনের সমস্যাগুলি নিয়ে এখানে কোনোরকম খোলাখুলি আলাপ আলোচনা বা ভাব বিনিময়ের সুযোগ না থাকায় জনগণের মধ্যে বিন্দুমাত্র রাজনৈতিক শিক্ষা ও চেতনার বিকাশ ঘটে না ।
সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী :
একনায়কতন্ত্রে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করা এবং রাষ্ট্র ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে পশুবল একমাত্র পদ্ধতিরূপে স্বীকৃত হয় । পুলিশ , মিলিটারি , গুপ্তচর বাহিনীর সাহায্যে সন্ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে একনায়ক তাঁর স্বৈরাচারী শাসনকে বজায় রাখেন । এজন্য কারাদণ্ড , নির্বাসন , গুপ্তহত্যার আশ্রয়ও নেওয়া হয় ।
মানবতার অভিশাপ :
একনায়কতন্ত্রকে মানবতার অভিশাপ বলে বর্ণনা করা হয় । এখানে মানবিক অধিকার বলে কিছুই থাকে না । একনায়ক তার স্বৈরাচারী শাসনের মাধ্যমে মানবতাকে পদদলিত করে ।
উপসংহার
একনায়কতন্ত্র সম্পূর্ণভাবে জনবিরোধী শাসন ব্যবস্থা । এই ব্যবস্থা ব্যক্তি স্বাধীনতার বিরোধী । একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে একনায়কতন্ত্রকে কোনোভাবেই কাম্য শাসনব্যবস্থা বলে অভিহিত করা যায় না ।