গণতন্ত্রের সুবিধা ও অসুবিধা

Contents

গণতন্ত্রের সুবিধা ও অসুবিধা

গণতন্ত্রকে সর্বশ্রেষ্ঠ শাসনব্যবস্থা রূপে গ্রহণ করা নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে । এই কারণে গণতন্ত্রের পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তির অবতারণা করা হয় । 

গণতন্ত্রের সুবিধা বা গুণ 

গণতন্ত্রের যেসব সুবিধা বা গুণের কথা বলা হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য —

সার্বভৌমত্বের বাস্তবায়ন : 

গণতন্ত্রে জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় । জনগণ এখানে সমগ্র রাষ্ট্র ক্ষমতার মূল উৎস । গণতন্ত্রে জনগণের সম্মতি নিয়ে সরকার গঠিত হয় । সরকার তার যাবতীয় কাজকর্মের জন্য জনগণের কাছে দায়িত্বশীল থাকে । 

স্বাভাবিক অধিকার তত্ত্বের রূপায়ণ : 

স্বাভাবিক অধিকারের তত্ত্ব ( Natural Rights Theory ) অনুসারে প্রতিটি ব্যক্তি তার জীবন , সম্পত্তি ও স্বাধীনতার যে অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে তা একমাত্র গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় বাস্তবায়িত হতে পারে । 

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা : 

গণতন্ত্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় । ফাইনারের মতে , একমাত্র গণতন্ত্রে আইনের যথাবিহিত পদ্ধতি ছাড়া ব্যক্তিজীবনে হস্তক্ষেপ করা যায় না । 

সর্বাধিক ব্যক্তির সর্বাধিক কল্যাণ : 

আদর্শবাদ অনুসারে গণতান্ত্রিক পরিবেশে ব্যক্তি তার আত্মবিকাশের সবচেয়ে বেশি সুযোগ পায় । অন্যদিকে হিতবাদী তত্ত্বের মূলনীতি — সর্বাধিক ব্যক্তির সর্বাধিক কল্যাণ , গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপায়িত হয় । 

স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ বিচার বিভাগের উপস্থিতি : 

গণতন্ত্রের একটি বড়ো গুণ হল এখানে স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ বিচার বিভাগের অস্তিত্ব বজায় থাকে । সংবিধানের রক্ষাকর্তা ও ব্যাখ্যাকর্তা নাগরিক অধিকারের সংরক্ষক হিসেবে বিচার বিভাগ গণতন্ত্রে এক উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করে । 

সাম্য , মৈত্রী ও স্বাধীনতার নীতি অনুসরণ : 

গণতন্ত্রে প্রত্যেকের সমানাধিকারের নীতি তত্ত্বগতভাবে ও বাস্তবে স্বীকৃত হয় । স্ত্রী-পুরুষ ও জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিককে আইনের দৃষ্টিতে সমান চোখে দেখা হয় এবং সকলে আইনের দ্বারা সমানভাবে সংরক্ষিত হওয়ার সুযোগ লাভ করে । গণতন্ত্রে স্বাধীনতার নীতি প্রতিষ্ঠাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয় । ব্যক্তিগত বা পৌর স্বাধীনতা , সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা গণতন্ত্রে বিশেষভাবে স্বীকৃতি লাভ করে ।

ন্যায় ও সত্যের প্রতিষ্ঠা : 

একমাত্র গণতন্ত্রেই ন্যায় ও সত্যের প্রতিষ্ঠা সম্ভব । প্রকৃত ন্যায় ও সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন পারস্পরিক আলাপ আলোচনা ও ভাবের আদান প্রদান , যা গণতন্ত্রেই শুধু সম্ভব । 

মানুষের মর্যাদা : 

গণতন্ত্রে প্রতিটি মানুষকে মর্যাদা দেওয়া হয় । মানবিক মর্যাদার এই স্বীকৃতি প্রকৃত গণতন্ত্র ছাড়া অন্য কোনো শাসন ব্যবস্থায় সম্ভব নয় । 

ব্যক্তিত্বের সর্বাঙ্গীন বিকাশ : 

রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে , গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় জনগণের অংশগ্রহণের অবারিত সুযোগ থাকায় তাদের মানসিক উৎকর্ষ সাধন ও ব্যক্তিত্বের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সম্ভব হয় । 

রাজনৈতিক চেতনার বৃদ্ধি : 

গণতন্ত্রে দেশের শাসন কাজে জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকায় এবং রাজনৈতিক দলগুলির সভা সমিতির প্রকাশ্য আলোচনার ফলে জনগণের রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি পায় । 

স্বৈরাচারের সম্ভাবনা হ্রাস পাওয়া : 

গণতন্ত্রে জনগণের মতামতই চূড়ান্ত বলে এখানে শাসকগোষ্ঠী স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারে না । কারণ , কোনো শাসকগোষ্ঠী যদি জনগণের মতামতের বিরুদ্ধাচরণ করে তবে পরবর্তী নির্বাচনে জনগণ কর্তৃক তাদের প্রত্যাখ্যাত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে । 

বিপ্লবের শঙ্কা হ্রাস পাওয়া : 

সরকার পরিবর্তনের ক্ষমতা জনগণের নিজেদের হাতে থাকে বলে কোনো জন বিক্ষোভ বা রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের সম্ভাবনা গণতন্ত্রে দেখা যায় না । নির্বাচনে শান্তিপূর্ণ উপায়ে জনগণের ভোটের মাধ্যমে অতি সহজেই সরকার পরিবর্তন করা যায় । 

গণতন্ত্রের অসুবিধা বা দোষ 

গণতন্ত্র সম্পূর্ণ ত্রুটি মুক্ত শাসনব্যবস্থা নয় । গণতন্ত্রের অসুবিধার দিকগুলি হল— 

দরিদ্র , অজ্ঞ ও অযোগ্যদের শাসনব্যবস্থা : 

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লেকি গণতন্ত্রের সমালোচনা করতে গিয়ে মন্তব্য করেছেন গণতন্ত্র হল সবচেয়ে দরিদ্র , অজ্ঞ ও অযোগ্য ব্যক্তির শাসনব্যবস্থা । কারণ গণতন্ত্রে এরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ । 

উৎকর্ষের পরিবর্তে সংখ্যার প্রাধান্য : 

গণতন্ত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন হওয়ায় এখানে গুণের তুলনায় সংখ্যার প্রাধান্য স্বীকৃত হয় । এখানে গুণগত উৎকর্ষ গুরুত্বহীন । 

সরকারের স্থায়িত্ব হীনতা : 

গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগণের বিভিন্ন রকমের স্বার্থ , জাতপাতের বৈষম্য , গোষ্ঠীগত ও আঞ্চলিক এবং ধর্মীয় সংকীর্ণতা ইত্যাদি পরস্পর বিরোধী বিষয় সক্রিয় থাকায় সরকারের স্থায়িত্ব ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয় । 

রক্ষণশীল শাসন ব্যবস্থা : 

সমালোচকদের মতে , গণতন্ত্র যেহেতু মূর্খ ও অযোগ্য ব্যক্তিদের শাসন , তাই এই ধরনের শাসনব্যবস্থাকে রক্ষণশীল বলা যায় । কারণ মূর্খ ও অযোগ্য ব্যক্তিদের মধ্যে কোনো প্রগতিশীল চিন্তার উন্মেষ ঘটে না । তারা সব সময় নতুন কিছু করার বিরোধী । 

দলীয় স্বার্থের প্রাধান্য : 

রাজনৈতিক দলগুলির অস্তিত্ব ছাড়া গণতন্ত্র কল্পনা করা যায় না । কিন্তু ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে যেভাবে দলীয় সংঘর্ষের সূচনা হয় তার ফলে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিছক তত্ত্বকথায় রূপান্তরিত হয় ।

ব্যয় বাহুল্য :

গণতন্ত্রে দেশের সাধারণ এবং অন্তর্বর্তী নির্বাচনগুলিতে সরকারকে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয় তা অনেক সময় অপচয়ের নামান্তর হয়ে দাঁড়ায় । এই বিপুল ব্যয়ভার প্রকারান্তরে দেশের সাধারণ নাগরিকদেরই বহন করতে হয় । 

আমলাতন্ত্রের প্রাধান্য : 

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আপামর জনগণের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার থাকায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যোগ্য ও সৎ প্রার্থীর চেয়ে অসৎ এবং অযোগ্য প্রার্থীরা নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকারি ক্ষমতা দখল করে । এই ধরনের অজ্ঞ নেতারা প্রশাসন পরিচালনা করার ব্যাপারে অদক্ষ হওয়ায় উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মী বা আমলাদের ওপর অত্যধিক পরিমাণে নির্ভরশীল হয়ে পড়েন । এভাবে গণতন্ত্রে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের চেয়ে আমলাদের প্রাধান্য বৃদ্ধি পায় । 

সংখ্যা লঘুর স্বার্থকে উপেক্ষা : 

গণতন্ত্র মানেই সংখ্যা গরিষ্ঠের শাসন , তাই সংখ্যা লঘুরা এখানে উপেক্ষিত হন এবং নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন । 

জরুরি অবস্থার অনুপযোগী :

সমালোচকরা মনে করেন , গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা জরুরি অবস্থার পক্ষে একেবারেই অনুপযুক্ত । কারণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাংবিধানিক নিয়মকানুনের প্রাধান্য থাকায় জরুরি বা সংকটকালীন পরিস্থিতিতে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয় না । 

উপসংহার 

এইধরনের বিরুদ্ধ সমালোচনা সত্ত্বেও এটা বলা যায় যে , গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই । ত্রুটি বিচ্যুতি সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আজও বিশ্বে সর্বশ্রেষ্ঠ শাসনব্যবস্থা । 

error: Content is protected !!