গণতন্ত্রের প্রকারভেদ
Contents
গণতন্ত্রের প্রকারভেদ
গঠনগত বা পরিচালনগত দিক থেকে সাধারণভাবে গণতন্ত্রকে দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায় । সেগুলি হল— [ 1 ] প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র এবং [ 2 ] পরোক্ষ গণতন্ত্র । তা ছাড়া তত্ত্বগত বা শ্রেণিগত দিক থেকে গণতন্ত্রকে [ 3 ] উদারনৈতিক গণতন্ত্র এবং [ 4 ] সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র — এই দুভাগে ভাগ করা যায় ।
প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র
যে শাসন ব্যবস্থায় জনগণ সরাসরি এবং সক্রিয়ভাবে শাসনকার্য পরিচালনায় অংশগ্রহণ করে তাকে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র বলে ।
খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে গ্রিসের এথেন্সে পেরিক্লিসের নেতৃত্বে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে । প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের নীতি অনুসারে বছরে একটি নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট নাগরিকরা একত্রিত হয়ে আইন প্রণয়ন , প্রশাসনিক নীতি নির্ধারণ , সরকারি আয়-ব্যয় নিয়ন্ত্রণ , বিদেশনীতি , যুদ্ধ ও শান্তি সংক্রান্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ , এমনকি বিচারের কাজকর্ম সম্পাদন করে থাকে । প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আইনগত সার্বভৌমত্ব এবং রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই ।
বর্তমানে বিলুপ্ত প্রায় এই শাসনব্যবস্থা সুইজারল্যান্ডের কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্যান্টনে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি স্থানীয় সরকার পরিচালনায় প্রচলিত রয়েছে । আধুনিক বিশ্বে বৃহৎ জনগোষ্ঠী সংবলিত রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র অবাস্তব হয়ে পড়েছে । প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে , রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডেভিড হেল্ড তাঁর Models of Democracy গ্রন্থে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রকে চিরায়ত বা ক্লাসিকাল গণতন্ত্ররূপে অভিহিত করেছেন ।
পরোক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র
পরোক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র বলতে সেই গণতন্ত্রকে বোঝায় যেখানে জনগণ তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে দেশ শাসনের কাজে অংশগ্রহণ করে । রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মিলের বক্তব্য অনুসারে , যে শাসন ব্যবস্থায় সমস্ত জনগণ বা জনগণের সংখ্যা গরিষ্ঠ অংশ নিজেদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে শাসন ক্ষমতাকে ব্যবহার করে থাকেন তাকে পরোক্ষ গণতন্ত্র বলা হয় ।
পরোক্ষ গণতন্ত্রে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাঁদের যাবতীয় কাজকর্মের জন্য জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকেন । পরোক্ষ গণতন্ত্রে জনগণ রাজনৈতিক দিক থেকে সার্বভৌম শক্তিরূপে স্বীকৃত হয় । এখানে সরকারের অস্তিত্ব জনগণের সম্মতির ওপর নির্ভরশীল । পরোক্ষ গণতন্ত্রে রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব এবং আইনগত সার্বভৌমত্বের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে ।
পরোক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের শাসনব্যবস্থা রাষ্ট্রপতি শাসিত বা মন্ত্রীপরিষদ চালিত হতে পারে । রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি জনগণের দ্বারা পরোক্ষভাবে নির্বাচিত হন । এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি দেশের প্রকৃত শাসক হিসেবে কাজ করেন । এর উদাহরণ হল , মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র । অন্যদিকে মন্ত্রীপরিষদ চালিত শাসনব্যবস্থায় প্রকৃত শাসক হল মন্ত্রীপরিষদ । মন্ত্রীপরিষদ চালিত শাসনব্যবস্থায় একজন নিয়মতান্ত্রিক শাসক বা আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রপ্রধান থাকেন , যেমন — ভারতের রাষ্ট্রপতি বা ব্রিটেনের রানি । মন্ত্রীপরিষদের সদস্যরা জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন । মন্ত্রীপরিষদ চালিত শাসনব্যবস্থার উদাহরণ হল ভারত , গ্রেট ব্রিটেন প্রভৃতি ।
উদারনৈতিক গণতন্ত্র
উদারনৈতিক গণতন্ত্র এক বিশেষ ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থা । গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে উদারনৈতিক দর্শনের বাস্তবায়ন এর লক্ষ্য । শাসনব্যবস্থায় জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ , রাজনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা , অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাবসা বাণিজ্যের অবাধ স্বাধীনতা , ব্যক্তির মর্যাদা ও স্বাধীনতার অধিকারের গুরুত্ব , সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা , আইনের অনুশাসন প্রতিষ্ঠা , অর্থনৈতিক স্বাধীনতার স্বীকৃতি , নির্বাচন ও নির্বাচিত হওয়ার অধিকার প্রভৃতি নীতির রূপায়ণ এই প্রকার গণতন্ত্রের লক্ষ্য ।
মধ্যযুগে সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের উদ্ভব ঘটে । ইংল্যান্ডে সপ্তদশ শতাব্দীতে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের সূচনা হয় । রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে ব্যক্তি স্বাধীনতার নীতি প্রতিষ্ঠা করাই হল উদারনৈতিক গণতন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য । শাসিতের সম্মতির ওপর প্রতিষ্ঠিত সরকারকে উদারনৈতিক গণতন্ত্রে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয় । এজন্য সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্বমূলক প্রশাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয় ।
উদারনৈতিক গণতন্ত্রের প্রবক্তারা আইনকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন বলে মনে করেন । চিন্তা ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা , ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রভৃতি ব্যক্তিগত স্বাধীনতাগুলিকে উদারনৈতিক গণতন্ত্রে অপরিহার্য বলে মনে করা হয় । উদারনৈতিক গণতন্ত্রে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করে অবাধ বাণিজ্যের নীতিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় । এ ছাড়া স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা , বহুদলীয় ব্যবস্থা , ব্যক্তিগত সম্পত্তির স্বীকৃতি প্রভৃতি উদারনৈতিক গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যরূপে বিবেচিত হয় ।
সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র
মার্কসবাদ ও লেনিনবাদের ওপর ভিত্তি করে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের উদ্ভব ঘটে । একে ‘ বৈপ্লবিক গণতন্ত্র ’ বা ‘ প্রকৃত গণতন্ত্র ‘ নামেও আখ্যায়িত করা হয় । মার্কসীয় তত্ত্ব অনুসারে , পুঁজিবাদী সমাজের ধ্বংসের পর সর্বহারাদের একনায়কত্বের অধীনে প্রতিষ্ঠিত প্রলেতারীয় গণতন্ত্র হল সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র । সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র হল পুঁজিবাদ থেকে সাম্যবাদে উত্তরণের এক মধ্যবর্তী পর্যায় । মার্কসবাদী ধারণায় সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র হল গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ বিকশিত রূপ । লেনিন একে নতুন এবং উচ্চতর গণতন্ত্র বলে দাবি করেছেন ।
সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রে শাসনব্যবস্থা মুষ্টিমেয় জনগণের স্বার্থে পরিচালিত হয় না । সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্র সমগ্র জনগণের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রুপান্তরিত হয় । মার্কসীয় মতবাদ অনুসারে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র হল এমন এক সমাজব্যবস্থা যেখানে জনগণের সামাজিক , রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সাম্য সুনিশ্চিত থাকে । উদারনৈতিক গণতন্ত্রে রাজনৈতিক ও সামাজিক সাম্য বজায় থাকলেও অর্থনৈতিক সাম্যের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয় না ।
সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রে অর্থনৈতিক বৈষম্য ও শোষণের অবসান ঘটিয়ে সাম্য প্রতিষ্ঠার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয় । এ ছাড়া সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের অন্যান্য তাৎপর্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানার বিলুপ্তি , সকলের জন্য সমানাধিকারের স্বীকৃতি , একদলীয় ব্যবস্থার উপস্থিতি , রাষ্ট্র কর্তৃক শ্রম ও ভোগের নিয়ন্ত্রণ , বিচারবিভাগের নিরপেক্ষ ভূমিকা প্রভৃতি ।