আধুনিক রাষ্ট্রে স্বাধীনতার রক্ষাকবচ গুলি কি কি

Contents

আধুনিক রাষ্ট্রে স্বাধীনতার রক্ষাকবচ গুলি কি কি

অধ্যাপক ল্যাস্কির মতে , স্বাধীনতা বলতে এমন এক পরিবেশের সযত্ব সংরক্ষণকে বোঝায় যে পরিবেশে মানুষ তার ব্যক্তিসত্তাকে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করতে পারে । রাষ্ট্র আইনের মাধ্যমে এই পরিবেশকে সংরক্ষণ করে । 

সমাজবদ্ধ মানুষের জীবনে স্বাধীনতা বলতে কখনও অবাধ বা অনিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতাকে বোঝায় না । রাষ্ট্র মানুষের অবাধ স্বাধীনতাকে আইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে সমাজকল্যাণের উপযোগী হিসেবে গড়ে তোলে । আইন হল স্বাধীনতার প্রথম রক্ষাকবচ । একজনের স্বাধীনতা ভোগ অন্যজনের সহযোগিতার ওপর নির্ভরশীল । তাই ব্যক্তি স্বাধীনতার যথাযথ সংরক্ষণে আইন অর্থাৎ স্বাধীনতার রক্ষাকবচ অবশ্য প্রয়োজন । 

ল্যাস্কির অভিমত হল , সমাজে সকলের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে স্বাধীনতার রক্ষাকবচের প্রয়োজন । আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বাধীনতার সংরক্ষণে বিভিন্ন রক্ষাকবচের ব্যবস্থা করা হয় । এই রক্ষাকবচগুলি হল— 

সংবিধানে লিপিবদ্ধ মৌলিক অধিকার 

সংবিধানে লিপিবদ্ধ মৌলিক অধিকারগুলিকে স্বাধীনতার প্রধান রক্ষাকবচ বলে গণ্য করা হয় । সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে মৌলিক অধিকার লিপিবদ্ধ থাকলে জনগণ সেগুলি সম্বন্ধে অবহিত হওয়ার সুযোগ পায় । সরকার যদি মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করে তাহলে জনগণ সাংবিধানিক পদ্ধতিতে নিজেদের অধিকার রক্ষার জন্য আদালতের শরণাপন্ন হতে পারে । ভারতের সংবিধানে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হিসেবে বাক্ ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা , সংঘ বা সমিতি গঠনের স্বাধীনতা , ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রভৃতিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে । এছাড়া মৌলিক অধিকার রক্ষার জন্য শাসনতান্ত্রিক প্রতিবিধানের অধিকার লিপিবদ্ধ করা হয়েছে । 

ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ 

মন্তেস্কু , ম্যাডিসন , ব্ল্যাকস্টোন প্রমুখ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণকে স্বাধীনতার অন্যতম রক্ষাকবচ হিসেবে অভিহিত করেছেন । তাঁদের মতে , সরকারের সমস্ত ক্ষমতা একই ব্যক্তি বা বিভাগের হাতে ন্যস্ত হলে স্বৈরাচারের সম্ভাবনা দেখা দেয় । এর ফলে ব্যক্তি স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হয় । সেজন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ প্রয়োজন । ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ থাকলে সরকারের কোনো বিভাগই ক্ষমতার যথেচ্ছ ব্যবহার করতে পারে না , ফলে ব্যক্তি স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ থাকে । 

আইনের অনুশাসন 

অধ্যাপক ডাইসি আইনের অনুশাসন বা ‘ Rule of law ‘ কে স্বাধীনতার একটি গুরুত্বপূর্ণ রক্ষাকবচ হিসেবে বর্ণনা করেছেন । ডাইসির মতে আইনের অনুশাসন বলতে বোঝায়— 

( 1 ) সাধারণ আইনের সর্বাত্মক প্রাধান্য , 

( ii ) আইনের চোখে সমতার নীতি অনুসরণ , 

( iii ) সাধারণ আইন দ্বারা নাগরিক অধিকারগুলির সংরক্ষণ । এর ফলে সরকারের স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার সুযোগ থাকে না , ফলে ব্যক্তি স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ থাকে । তা ছাড়া , সবার জন্য একই আইনের অস্তিত্ব থাকায় প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিক পর্যন্ত কেউই বাড়তি সুবিধা ভোগ করতে পারে না । গ্রেট ব্রিটেনের সংবিধান আইনের অনুশাসনের নীতিটিকে পুরোপুরি গ্রহণ করেছে । 

দায়িত্বশীল শাসন ব্যবস্থা 

দায়িত্বশীল শাসন ব্যবস্থা হল স্বাধীনতার আর একটি রক্ষাকবচ । দায়িত্বশীল শাসন ব্যবস্থায় সরকার আইন সভায় জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে দায়বদ্ধ থাকে । তা ছাড়া , আইনসভার ভিতরে ও বাইরে বিরোধীপক্ষের সমালোচনার ভয়ে সরকার জনগণের স্বাধীনতার পরিপন্থী কোনো কাজ করতে সাহস পায় না । কারণ সুসংবদ্ধ বিরোধী দল জনমতকে সজাগ রাখতে সাহায্য করে । 

প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতি 

গণভোট , গণ উদ্যোগ , পদচ্যুতি প্রভৃতি প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে স্বাধীনতার অন্যতম রক্ষাকবচ বলে গণ্য করা হয় । সরকার নাগরিক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করলে জনগণ প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে । এমনকি সরকারকে ক্ষমতা চ্যুত করাও সম্ভব হয় । অবশ্য বৃহদায়তন জনবহুল দেশগুলিতে এইসব পদ্ধতি অনুসরণ করা অসম্ভব । এখানে উল্লেখ করা যায় যে , সুইজারল্যান্ডের মতো ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিগুলি বর্তমানে আংশিকভাবে চালু রয়েছে ।

ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ 

ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হিসেবে স্বীকৃত । বলা হয় যে , প্রশাসনিক ক্ষমতা অতিমাত্রায় কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়লে শাসন বিভাগের স্বৈরাচারী হওয়ার প্রবণতা দেখা দেয় , যার ফলে ব্যক্তি স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয় । অধ্যাপক ল্যাস্কির মতে , যে রাষ্ট্রে কেন্দ্রের হাতে অতিমাত্রায় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত সেখানে স্বাধীনতা থাকতে পারে না । 

সদাজাগ্রত জনমত 

স্বাধীনতার সর্বশ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ হিসেবে সদাজাগ্রত জনমতের কথা উল্লেখ করা হয় । স্বাধীনতার জন্য নাগরিকদের অদম্য আকাঙ্ক্ষা এবং সবরকম ত্যাগ স্বীকারের ইচ্ছা ছাড়া স্বাধীনতা রক্ষা করা যায় না । স্বাধীনতার ওপর যে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে নাগরিকদের সর্বদা সচেতন থাকা প্রয়োজন । গ্রিক দার্শনিক পেরিক্লিস বলেছিলেন যে , চিরন্তন সতর্কতা হল স্বাধীনতার মূল্য এবং সাহসিকতা হল স্বাধীনতার মূল মন্ত্র । 

স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা 

স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারবিভাগের অস্তিত্ব ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার এক গুরুত্বপূর্ণ রক্ষাকবচ । বিচারবিভাগ স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে তার ভূমিকা পালন করতে পারলে নাগরিকদের অধিকার সুরক্ষিত করা সম্ভব হয় । নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ ন্যায় বিচারকে সুনিশ্চিত করে । এরফলে ব্যক্তি স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ থাকে । 

উপসংহার 

পরিশেষে বলা যায় , স্বাধীনতা কখনও খণ্ডিতভাবে উপলব্ধি করা যায় না । সমাজের কোনো অংশের স্বাধীনতা অস্বীকার করে প্রকৃত স্বাধীনতার পরিবেশ গড়ে তোলা যায় না । তাই নিছক আনুষ্ঠানিক পদ্ধতির মাধ্যমে স্বাধীনতা সংরক্ষণ সম্ভব নয় । এজন্য জনগণকে সদাসচেষ্ট থাকতে হবে । 

error: Content is protected !!