আন্তর্জাতিকতা কাকে বলে
Contents
আন্তর্জাতিকতা কাকে বলে
আন্তর্জাতিকতার সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে যথেষ্ট মতবিরোধ রয়েছে । বস্তুতপক্ষে , আন্তর্জাতিকতা হল এক বিশেষ মানসিক অনুভূতি । আন্তর্জাতিকতা এক মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত । আন্তর্জাতিকতা বিশ্বভ্রাতৃত্ব এবং বিশ্বশান্তির আদর্শে বিশ্বাস করে । রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গোল্ড স্মিথের মতে , আন্তর্জাতিকতার অনুভূতি মানুষকে শুধুমাত্র নিজের জাতীয় রাষ্ট্রের সদস্য হিসেবেই ভাবতে শেখায় না , একজন বিশ্ব নাগরিকরূপেও ভাবতে শেখায় ।
আন্তর্জাতিকতা বিভিন্ন জাতির মধ্যেকার স্বাতন্ত্র্যবোধ অটুট রেখেই অর্থনৈতিক , রাজনৈতিক , সাংস্কৃতিক সহযোগিতার বন্ধনকে দৃঢ় করে স্বাধীনতা , সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে এক বিশ্বমানব সমাজ গড়ে তুলতে চায় । জাতীয় রাষ্ট্রগুলির মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও সহযোগিতার ফলে বিশ্বে যে গভীর একাত্মবোধ দেখা দেয় তা আন্তর্জাতিকতার পথকে প্রশস্ত করে । আধুনিক বিশ্ব পরিস্থিতিতে ক্ষুদ্র বৃহৎ কোনো রাষ্ট্রের পক্ষেই আত্মকেন্দ্রিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে টিকে থাকা সম্ভব নয় । তাই আন্তর্জাতিকতা আজ এক তাৎপর্যপূর্ণ ধারণা ।
বিগত শতাব্দীতে পরপর দুটি বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসলীলার পরে বর্তমানে পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কার প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিকতার চিন্তা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘ ( League of Nations ) স্থাপনের মধ্যে দিয়ে আন্তর্জাতিকতার আদর্শ সর্বপ্রথম সাংগঠনিক চেহারা নেয় । বর্তমানে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ ( United Nations Organization ) বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিকতার আদর্শকে বাস্তবে রূপায়ণের কাজ করে চলেছে ।
আন্তর্জাতিকতার গুরুত্ব
আন্তর্জাতিকতা হল এক মহান আদর্শ । বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও বিশ্বশান্তির আদর্শের ধারক ও বাহক আন্তর্জাতিকতার গুরুত্ব নানান দিক থেকে অনুধাবন করা যায় , যেমন ―
বিশ্ব শান্তি ও মানব সভ্যতার সংরক্ষক :
আন্তর্জাতিকতার আদর্শ আমাদের যুদ্ধহীন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখায় , মানব সভ্যতাকে রক্ষা ক’রে সমৃদ্ধির পথে চালিত করে । অধ্যাপক হ্যারল্ড ল্যাস্কি যথার্থই মন্তব্য করেন যে , আন্তর্জাতিকতার আদর্শে আমাদের বাঁচতে হবে , নয়তো ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী । বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে , হয় মানুষ যুদ্ধকে নিশ্চিহ্ন করবে , নতুবা যুদ্ধই মানুষকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে ।
বিশ্ব সমৃদ্ধির সহায়ক :
আন্তর্জাতিকতার আদর্শ গ্রহণ করা হলে পৃথিবীতে যুদ্ধের কোনো প্রয়োজন থাকবে না । যুদ্ধের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে সামরিক ব্যয় , অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণ , বিশাল সেনাবাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণ কোনো কিছুই দরকার হবে না । এর ফলে যে পরিমাণ অর্থের সাশ্রয় হবে তাতে সমগ্র বিশ্ববাসী সুখে সমৃদ্ধিতে বসবাস করতে পারবে ।
পারস্পরিক সহযোগিতার প্রসারক :
বিশ্বে কোনো রাষ্ট্র আজ আর বিচ্ছিন্নভাবে টিকে থাকতে পারে না । একবিংশ শতাব্দীর বিশ্ব সর্বতোভাবে এক পারস্পরিক নির্ভরশীল বিশ্ব । মুক্ত বাণিজ্য নীতি , অবাধ পণ্য চলাচল , আর্থিক সংস্কার , সাংস্কৃতিক বিনিময় , বিশ্বায়ন ইত্যাদি কারণে রাষ্ট্রগুলি একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল । একমাত্র আন্তর্জাতিকতার পথেই বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থা উন্নততর পর্যায়ে উপনীত হতে পারে ।
জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নতির সহায়ক :
আন্তর্জাতিকতার আদর্শ রূপায়িত হলে পৃথিবীর নানা প্রান্তের সঙ্গে যে ঘনিষ্ঠ সংযোগ গড়ে উঠবে তার ফলে জ্ঞান বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতির পথ প্রশস্ত হবে ।
উপনিবেশবাদ এবং নয়া উপনিবেশবাদের গতিরোধকারী :
আন্তর্জাতিকতার আদর্শ গৃহীত হলে উপনিবেশবাদ ও নয়া উপনিবেশবাদ পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হতে পারে । আন্তর্জাতিকতার আদর্শে নতুন বিশ্বরাষ্ট্র গঠিত হলে ছোটোবড়ো সমস্ত জাতি রাষ্ট্র সমমর্যাদার অধিকারী হতে পারে ।
উপসংহার
আন্তর্জাতিকতার কোনো বিকল্প নেই । বস্তুতপক্ষে , পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা পৃথিবীর বুকে যত বেশি ঘনিয়ে আসবে মানুষের মনে তত বেশি করে আন্তর্জাতিকতার আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়ে দেখা দেবে । তাই , সংকীর্ণ স্বার্থের আঘাতে জর্জরিত পৃথিবীতে আন্তর্জাতিকতাবাদ আজ অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক ।