রাষ্ট্র বিজ্ঞান

জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার

Contents

জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার

প্রত্যেক জাতির স্বাধীন ও স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠন করার অধিকারকে বলা হয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার । আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার তত্ত্বের মূলভিত্তি হল ‘ এক জাতি এক রাষ্ট্র ’ নীতি । এই নীতি অনুসারে প্রতিটি রাষ্ট্র হবে জাতিভিত্তিক । এক একটি জাতিকে নিয়ে গঠিত হবে এক-একটি রাষ্ট্র । কোনো রাষ্ট্র যদি পাঁচটি জাতিকে নিয়ে গঠিত হয়ে থাকে তাহলে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নীতি অনুসারে ওই রাষ্ট্রকে ভেঙে পাঁচটি আলাদা আলাদা রাষ্ট্র তৈরি করতে হবে । 

এই নীতি অনুযায়ী প্রত্যেক আত্মসচেতন জাতিই তার নিজস্ব সত্তা ও বৈশিষ্ট্য রক্ষা করতে চায় । তাই প্রত্যেক জাতির পৃথক রাষ্ট্র থাকা দরকার । এই তত্ত্বের অন্যতম প্রবক্তা জন স্টুয়ার্ট মিলের বক্তব্য হল , জাতীয় জনসমাজের সীমানা রাষ্ট্রের সীমানার সঙ্গে সামস্যপূর্ণ হওয়া বাঞ্ছনীয় । 

লেনিনের মতে , বিদেশি শাসন থেকে মুক্তি ও স্বাধীন সরকার গঠন বা অত্যাচারী শাসকের হাত থেকে রাজনৈতিক মুক্তি হল আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার । ১৭৭২ সালে পোল্যান্ডের বিভক্তিকরণের ঘটনাকে ভিত্তি করেই জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত আলোচনার সূত্রপাত ঘটে । 

ভিয়েনা কংগ্রেস ( ১৮১৫ ) অনুষ্ঠিত হওয়ার পর সমগ্র ইউরোপে জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নীতি সমর্থিত হয় । জার শাসিত রাশিয়ায় ( ১৯১৭ ) আত্মনিয়ন্ত্রণের পক্ষে জোরালো দাবি উত্থাপিত হয় । মার্কিন রাষ্ট্রপতি উইলসনের ১৪ দফা দাবির ( ১৯১৮ ) অন্যতম ছিল ঔপনিবেশিক শাসনাধীন জাতিগুলির আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি সম্পর্কিত প্রস্তাব । প্রকৃতপক্ষে , ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নীতিটি বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করে । 

জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এর পক্ষে যুক্তি 

জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের পক্ষে যাঁরা বক্তব্য রেখেছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন জন স্টুয়ার্ট মিল , বার্ট্রান্ড রাসেল , উড্রো উইলসন প্রমুখ চিন্তানায়ক । মার্কসবাদে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদের বিরুদ্ধে এক প্রগতিশীল আন্দোলন বলে অভিহিত করা হয়েছে । জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের পক্ষে যুক্তিগুলি হল : 

সংখ্যালঘু সমস্যার সমাধানে সহায়ক : 

মার্কিন রাষ্ট্রপতি উইলসনের বক্তব্য হল , প্রতিটি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বিশ্বজনীন ভাবে মেনে নেওয়া প্রয়োজন । কারণ এর ফলে সংখ্যালঘু সমস্যার সমাধান হবে এবং বিভিন্ন জাতির মধ্যে দ্বন্দ্ব , বৈরীভাব প্রভৃতির অবসান হয়ে পৃথিবী থেকে যুদ্ধের ভয় দূর হবে । 

গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার পক্ষে উপযুক্ত :

জন স্টুয়ার্ট মিলের মতে , বহুজাতি ভিত্তিক রাষ্ট্রে জনগণের মধ্যে পারস্পরিক সদ্ভাব ও সম্প্রীতি থাকে না । তাই গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সাফল্যের জন্য মিল একজাতিভিত্তিক আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে স্বীকার করে নেওয়ার পক্ষে যুক্তি দেখান । 

জাতীয় গুণাবলির বিকাশে সহায়ক :

আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের নীতির প্রবক্তাদের মতে , প্রতিটি জাতির কিন্তু মৌলিক বৈশিষ্ট্য বা গুণাবলি রয়েছে । এসব গুণাবলির পূর্ণাঙ্গ বিকাশ শুধুমাত্র জাতীয় সরকারের মাধ্যমেই ঘটা সম্ভব ।

বিশ্বসভ্যতার বিকাশে সহায়ক :

প্রতিটি জাতির নিজস্ব রাষ্ট্র ও সরকার থাকলে সেই জাতির সভ্যতা ও সংস্কৃতি দ্রুত বিকশিত হয় । এইভাবে বিশ্বব্যাপী সভ্যতার বিকাশে বিভিন্ন জাতির মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বিশ্ব সংস্কৃতির সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি সম্ভব হয় । 

নৈতিক মানদণ্ডে সমর্থনযোগ্য : 

নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে বলা হয় , প্রতিটি জাতির স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ভাগ্য নির্ধারণ করার অধিকার থাকা বাঞ্ছনীয় । এই ন্যায় সংগত দাবি অর্জিত হলে দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার বন্ধ হতে পারে । 

জাতিগত সংঘাতের সম্ভাবনা হ্রাসকারী :

আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বীকৃত হলে কিংবা এক জাতি , এক রাষ্ট্র গঠিত হলে জাতিগত সংঘাত বা বিরোধের আশঙ্কা দুর হবে । বহুজাতি ভিত্তিক রাষ্ট্রে বিভিন্ন জাতীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে পারস্পরিক বিদ্বেষ ও জাতি দাঙ্গা দেখা যায় তা এখানে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা কম । 

রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের সঙ্গে ব্যক্তি স্বাধীনতার সমন্বয় সাধক : 

একটি জাতির নিজস্ব সরকার থাকলে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের সঙ্গে ব্যক্তি স্বাধীনতার সুষ্ঠু সমন্বয় সাধন সম্ভব হয় । তা ছাড়া একটি রাষ্ট্রে শুধুমাত্র একটি জাতি থাকলে কোনো অভ্যন্তরীণ বিবাদ বিসংবাদ না থাকায় প্রত্যেকে নিজের দেশকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতে সক্ষম হয় । 

জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের বিপক্ষে যুক্তি

জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের তত্ত্বটি নানা দিক থেকে সমালোচিত হয়েছে । সমালোচকরা এই তত্ত্বের বিপক্ষে যে যুক্তিগুলি দেখিয়েছেন সেগুলি হল— 

অখন্ডতার পরিপন্থী : 

‘ এক জাতি , এক রাষ্ট্র ’ নীতি স্বীকৃত হলে পৃথিবীর বৃহৎ রাষ্ট্রগুলি বহুবিভক্ত হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে পরিণত হবে । এইসব ক্ষুদ্র ও দুর্বল রাষ্ট্র কখনোই আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি গড়ে তুলতে পারবে না । এরা বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলির শিকারে পরিণত হবে । 

অবাস্তব : 

এই তত্ত্ব অবাস্তব । কারণ , একই ভৌগোলিক পরিবেশে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ দীর্ঘকাল পরস্পর একত্রে বসবাস করার ফলে তাদের বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হয় না । জাতিগত বিভেদের পরিপ্রেক্ষিতে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হলেও ( ১৯৪৭ সাল ) ভারতে বহু মুসলমান জনগোষ্ঠীর মানুষ এখনও রয়েছেন । 

উন্নত সভ্যতা ও সংস্কৃতির পরিপন্থী : 

ইংরেজ দার্শনিক লর্ড অ্যাক্টনের বক্তব্য হল , বহুজাতি ভিত্তিক রাষ্ট্র সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক থেকে উন্নততর পর্যায়ে যেতে সমর্থ হয় । অন্যদিকে , রাষ্ট্রীয় সীমারেখার ভিতর যেখানে শুধু একটিমাত্র জাতি বসবাস করে সেই সমাজ অনগ্রসর হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে । 

উদ্বাস্তু সমস্যার সৃষ্টিকারী : 

বহুজাতি ভিত্তিক রাষ্ট্রগুলিকে জাতীয়তার ভিত্তিতে বিচ্ছিন্ন করা হলে উদ্বাস্তু সমস্যার সৃষ্টি হবে । জাতীয়তার ভিত্তিতে ভারত বিভাগের ফলে বহু হিন্দু পরিবার উদ্বাস্তু হিসেবে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে আসতে বাধ্য হন । এর ফলে ভারতে তীব্র উদ্বাস্তু সমস্যা দেখা দেয় । 

সংখ্যালঘু সমস্যার সমাধানে সহায়ক নয় : 

উইলসনের মতে , জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার তত্ত্ব সংখ্যালঘু সমস্যা সমাধান ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক । সমালোচকরা এ যুক্তি মানতে পারেননি । কারণ , এই তত্ত্বের ভিত্তিতে অবিভক্ত ভারত দ্বিখণ্ডিত হয় , তা সত্ত্বেও ভারত ও পাকিস্তানের সংখ্যালঘু জাতি সমস্যার সমাধান হয়নি । 

অগণতান্ত্রিক : 

‘ এক জাতি , এক রাষ্ট্র ’ তত্ত্বের সঙ্গে গণতন্ত্রের কোনো সম্পর্ক নেই । বহুজাতি ভিত্তিক ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সুইজারল্যান্ডের অধিবাসীরা কোনো অংশে কম গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করেন না । 

বৈরী মনোভাবের জন্মদাতা : 

লর্ড কার্জনের মতে , জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার তত্ত্ব হল এমন একটি অস্ত্র যার দু দিকেই ধার আছে । একদিকে যেমন এই নীতিটি একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ ও রাজনৈতিক চেতনা সম্পন্ন করতে সাহায্য করে , অন্যদিকে তেমনি বিভিন্ন জাতিকে বিচ্ছিন্ন করে তাদের মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণা , বিদ্বেষ ও সন্দেহের সৃষ্টি করে তৈরী মনোভাবের জন্ম দেয় ।

ইতিহাসের পশ্চাদগতির সূচক : 

লর্ড অ্যাক্টনের মতে , আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ইতিহাসের পশ্চাদ গতির ইঙ্গিত দেয় । এই সভ্য যুগে মানুষ একতাবদ্ধ হয়ে থাকার বদলে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে চাইলে তা মানব সমাজের পশ্চাদ গতির সূচনা করবে । 

error: Content is protected !!