জাতীয় জনসমাজের উপাদান 

Contents

জাতীয় জনসমাজের উপাদান 

যেসব সুনির্দিষ্ট উপাদানের সাহায্যে কোনো জনসমাজ জাতীয় জনসমাজের পর্যায়ে উন্নীত হয় তাকে জাতীয় জনসমাজের উপাদান বলে । রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা জাতীয় জনসমাজ গঠনের উপাদানগুলিকে দুটি ভাগে ভাগ করেছেন । সেগুলি হল —–— [ 1 ] বাহ্যিক বা বস্তুগত উপাদান , [ 2 ] ভাবগত উপাদান । 

বাহ্যিক বা বস্তুগত উপাদান 

জাতীয় জনসমাজ গঠনের বাহ্যিক বা বস্তুগত উপাদান গুলি হল ―

ভৌগোলিক একতা : 

কোনো একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকায় কোনো জনসমষ্টি দীর্ঘকাল একত্রে বসবাস করলে তাদের মধ্যে যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে তা এক গভীর একাত্মবোধের জন্ম দেয় । 

অবশ্য ভৌগোলিক একতা ছাড়াও জাতীয় জনসমাজ গঠিত হওয়ার দৃষ্টান্ত হিসেবে ইহুদিদের দ্বারা গঠিত ইজরায়েল রাষ্ট্রের কথা বলা যায় । 

বংশগত ঐক্য : 

কোনো জনসমাজের অন্তর্গত মানুষেরা নিজেদের একই বংশের লোক মনে করলে তাদের মধ্যে যে গভীর একাত্মতার সৃষ্টি হয় , তা এক সুদৃঢ় জাতীয়তাবোধের জন্ম দেয় । 

অবশ্য ব্রিটিশ , ফরাসি , মার্কিন ও ভারতীয়দের মতো সমৃদ্ধ জাতিগুলির কোনো বংশগত ঐক্যবোধ নেই ।

ভাষাগত ঐক্য : 

একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকায় একই ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী থাকলে ভাষাগত ঐক্যের ভিত্তিতে তাদের মধ্যে এক ধরনের সহজাত একাত্মবোধের জন্ম হয় । এইভাবে ভাষার সূত্রে জাতীয় ঐতিহ্য , সাহিত্য ও সংস্কৃতির এক মজবুত বুনিয়াদ রচিত হয় ( যেমন — বাংলাদেশ ) । 

অবশ্য পৃথিবীতে বহু ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীকে নিয়ে জাতীয় জনসমাজ গঠিত হওয়ার দৃষ্টান্তও রয়েছে ( যেমন – ভারত ) । 

ধর্মগত ঐক্য : 

একই ধর্মের মানুষদের মধ্যে সমজাতীয় ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান , ধর্মীয় উপাসনা ইত্যাদি প্রচলিত থাকায় গভীর একাত্মবোধের উদ্ভব হয় । অবশ্য ধর্মগত ঐক্য জাতীয় জনসমাজ গঠনের অপরিহার্য উপাদান নয় । আধুনিক পৃথিবীর অধিকাংশ রাষ্ট্রই ধর্মনিরপেক্ষ । 

রাষ্ট্রনৈতিক ঐক্য : 

দীর্ঘকালব্যাপী কোনো জনসমষ্টি একই সরকারের অধীনে থাকলে তাদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই ঐক্যবোধের সৃষ্টি হয় । দৃষ্টান্ত স্বরূপ ব্রিটিশ শাসনাধীনে থাকা ভারতবর্ষের কথা উল্লেখ করা যায় । 

অর্থনৈতিক সমস্বার্থ : 

জাতীয় জনসমাজ গঠনের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল একই ধরনের অর্থনৈতিক স্বার্থের বন্ধন । অর্থনৈতিক স্বার্থের অভিন্নতা জনগোষ্ঠীকে বিপ্লবে সামিল করেছে এমন দৃষ্টান্ত ইতিহাসে অনেক আছে । সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের কথা এক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যায় । 

ভাবগত উপাদান

জাতীয় জনসমাজ গঠনের ক্ষেত্রে শুধু বাহ্যিক বা বস্তুগত উপাদানই যথেষ্ট নয় , ভাবগত ঐকাও অপরিহার্য । জাতীয় জনসমাজ গঠনে ভাবগত উপাদানই হল মূল ঐক্যবিধানকারী শক্তি ( cementing factor ) । ফরাসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রেণাঁর মতে , জাতীয় জনসমাজ সম্পর্কিত ধারণা হল প্রধানত একটি ভাবগত ধারণা ।

কোনো জনসমাজ যখন ভাবে যে তাদের সুখ-দুঃখ , ব্যথা-বেদনা , আশা-আকাঙ্ক্ষা , গৌরব-গ্লানি সব এক , তখন সেই জনসমাজের চেতনায় জাতীয়তাবোধের সঞ্চার ঘটে । এইভাবে পৌরবময় স্মৃতি বিজড়িত ইতিহাস , ভবিষ্যতের স্বপ্ন এবং সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সমন্বয় ইত্যাদির ফলে জনসমাজের মধ্যে যে আত্মীয়তার বোধ গড়ে ওঠে তা জাতীয় জনসমাজ ও পরবর্তী পর্যায়ে জাতি গঠনের সহায়ক উপাদানরূপে কাজ করে । 

উপসংহার 

পরিশেষে বলা যায় , জাতীয় জনসমাজ গঠনের জন্য বাহ্যিক উপাদান ও ভাবগত উপাদানের মধ্যে কোনো একটিমাত্র উপাদান জাতিগঠনের ক্ষেত্রে অপরিহার্য নাও হতে পারে , উভয় উপাদানের মিলিত ভূমিকা অনেক সময় সমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে । 

error: Content is protected !!