পবিত্র চুক্তি ও চতুঃশক্তি চুক্তি
Contents
পবিত্র চুক্তি ও চতুঃশক্তি চুক্তি
নেপোলিয়ন বোনাপার্টের পতন ঘটানোর প্রধান ভূমিকা ছিল রাশিয়া , প্রাশিয়া , অস্ট্রিয়া ও ইংল্যাণ্ডের । নেপোলিয়নের পতনের পর এই বিজয়ী শক্তিবর্গ ভিয়েনা সম্মেলনে নতুন ভাবে ইউরোপে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করে । অতঃপর এদের সামনে প্রধান সমস্যা ছিল ভিয়েনা সিদ্ধান্তকে স্থায়ী করা এবং ইউরোপে শান্তি বজায় রাখা ।
সেই মুহূর্তে প্রতিটি রাষ্ট্রই অনুভব করেছিল যে , সম্মিলিত প্রয়াসের দ্বারাই তারা এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে । তাই বিজয়ী শক্তিবর্গ একটি স্থায়ী আন্তর্জাতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন উপলব্ধি করে । এই উদ্দেশ্যে রাশিয়া ও অস্ট্রিয়া দু’টি চুক্তির খসড়া রচনা করে । এগুলিই যথাক্রমে ‘ পবিত্র চুক্তি ‘ ( Holly Alliance ) ও ‘ চতুঃশক্তি চুক্তি ‘ ( Quadruple Alliance ) নামে খ্যাত ।
পবিত্র চুক্তি
পবিত্র চুক্তির উদগাতা রাশিয়ার জার প্রথম আলেকজাণ্ডার । তিনি ছিলেন ভাবপ্রবণ , আদর্শবাদী । ফন ক্রুডিনার নামক জনৈকা সন্ন্যাসিনীর সংস্পর্শে এসে তিনি ধর্মের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হন । তা ছাড়া , আলোচ্য সময়ে ইউরোপে এক ধরনের ধর্মীয় পুনর্জাগরণ শুরু হয়েছিল । এই ধর্ম প্রভাবে আলেকজাণ্ডারের ধারণা হয় যে , ইউরোপীয় রাজারা যদি খ্রীষ্টীয় ধর্মশাস্ত্র অনুসারে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ করেন , তা হলে ইউরোপের অশান্তি প্রশমিত হবে । এই ধারণার বশবর্তী হয়ে আলেকজাণ্ডার ইউরোপের খ্রীষ্টান দেশগুলিকে একটি জোট তৈরির আহ্বান জানান । এই উদ্দেশ্যে তিনি রচনা করেন ‘ পবিত্র চুক্তি’র খসড়া । ১৮১৫ খ্রীষ্টাব্দের ২৬ শে সেপ্টেম্বর এই পরিকল্পনা সরকারীভাবে ঘোষণা করা হয় ।
পবিত্র চুক্তির শর্ত :
পবিত্র চুক্তিতে বলা হয় –
( ১ ) স্বাক্ষরকারী রাজন্যবর্গ পরস্পরকে ভ্রাতৃ জ্ঞান করবে ।
( ২ ) প্রজা ও কর্মচারীদের প্রতি রাজা পরিবারের পিতার ন্যায় আচরণ করবেন ।
( ৩ ) রাজারা খ্রীষ্টীয় আদর্শ ‘ ন্যায় , প্রেম ও শান্তি’কে অবলম্বন করে দেশকে পরিচালিত করবেন ইত্যাদি ।
পবিত্র চুক্তিতে যোগদানের জন্য পোপ ও তুরস্কের সুলতান ছাড়া অন্যান্য ইউরোপীয় রাজাদের আহ্বান করা হয় । পোপ ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির সমর্থক ও তুরস্কের সুলতান ছিলেন ইসলাম ধর্মাবলম্বী , তাই তাঁদের বাদ রাখা হয় । রাশিয়া , প্রাশিয়া ও অস্ট্রিয়া পবিত্র চুক্তিতে স্বাক্ষর করে । কিন্তু ইংল্যাণ্ড নানা কারণে এতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করে ।
বাস্তব ক্ষেত্রে পবিত্র চুক্তি ছিল অকার্যকরী । একমাত্র জার প্রথম আলেকজাণ্ডার ছাড়া অন্য কারও এই চুক্তির প্রতি আস্থা ছিল না । অস্ট্রিয়া বা প্রাশিয়া এতে যোগদান করেছিল কেবলমাত্র জারকে খুশি করার জন্য ।
মেটারনিখ স্বয়ং এই চুক্তিকে ‘ অর্থহীন উচ্চানাদ ‘ ( High sounding nothing ) বলে অভিহিত করেছেন । তালেরাঁ’র কাছে এটি ছিল ‘ হাস্যকর চুক্তি ‘ । ক্যাসলরি এটিকে ‘ অতীন্দ্রিয় বোকামি ’ বলে মনে করতেন । আসলে কোন চুক্তির ন্যূনতম আবশ্যিক শর্তগুলিও এতে ছিল না । অর্থাৎ যে কোন চুক্তির একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে এবং সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর সুনির্দিষ্ট পথ নির্দেশিকা থাকে । কিন্তু এতে তার কিছুই ছিল না ।
আরো পড়ুন : মেটারনিক ব্যবস্থা
চতুঃশক্তি চুক্তি
ইংল্যাণ্ড , অস্ট্রিয়া , প্রাশিয়া ও রাশিয়া যেদিন প্যারিসের দ্বিতীয় চুক্তি স্বাক্ষর করে , সেই দিনই তারা ‘ চতুঃশক্তি মৈত্রী চুক্তি ‘ ( Quadruple Alliance ) স্বাক্ষর করে ( ২০ শে নভেম্বর ১৮১৫ খ্রীঃ ) ।
চতুঃশক্তি চুক্তির শর্ত :
‘ চতুঃশক্তি চুক্তি ’ ছিল অনেক বেশী বাস্তবধর্মী ও কার্যকরী । প্রকৃতপক্ষে চতুঃশক্তি চুক্তিকে ভিত্তি করেই ‘ ইউরোপীয় শক্তি – সমবায় ’ গড়ে ওঠে । চতুঃশক্তি চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রগুলি অঙ্গীকার করে যে ,
( ১ ) যে কোন শর্তে ভিয়েনা সন্ধি , প্যারিসের সন্ধি ও পেমোর সন্ধির শর্তাবলী বজায় রাখা হবে ।
( ২ ) ফরাসী সিংহাসনে কোনদিনই বোনাপার্ট বংশীয় কাউকে বসতে দেওয়া হবে না ।
( ৩ ) পারস্পরিক আলোচনা ও সহযোগিতার ভিত্তিতে ইউরোপের শান্তি অব্যাহত রাখা হবে ।
( ৪ ) ইউরোপের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও উদ্ভূত সমস্যা সমাধানের উপায় নির্ধারণের জন্য স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রবর্গ মাঝে মাঝে বৈঠকে সমবেত হবে ।
এইরকম সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র চতুষ্টয় প্রথম থেকেই একমত ছিল না । বিশেষ করে ইংল্যাণ্ডের সাথে অস্ট্রিয়ার মতভেদ প্রথম থেকেই ছিল যথেষ্ট । ইংল্যাণ্ডের উদ্দেশ্য ছিল ভিয়েনায় গৃহীত নতুন রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে বজায় রাখা এবং ফ্রান্সে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের মত কোন অসাধারণ ব্যক্তিত্বের উত্থান রোধ করা ।
কিন্তু মেটারনিখ এই চুক্তিকে তাঁর যে কোন পরিবর্তন বিরোধী ও উদারতন্ত্র বিরোধী অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন । ইংল্যাণ্ড রাজনীতির স্বার্থে যে কোন দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের বিরোধী ছিল । কিন্তু মেটারনিখ চেয়েছিলেন রাজক্ষমতা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য এবং প্রজাশক্তি বৃদ্ধি বা গণ আন্দোলন রোধ করার জন্য যে কোন দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে । উদারতন্ত্রী ইংল্যাণ্ডের সাথে রক্ষণশীল অস্ট্রিয়ার এই আদর্শগত মত বিরোধ শেষ পর্যন্ত এই চুক্তির পতন ডেকে আনে ।
আরো পড়ুন : মেটারনিক ইউরোপীয় রক্ষণশীলতার জনক বলার কারণ