ইতিহাস

নেপোলিয়নের উত্থানের কারণ

Contents

নেপোলিয়নের উত্থানের কারণ

নেপোলিয়ন বোনাপার্ট সাধারণ একজন সৈনিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই ফ্রান্সের সম্রাট পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন । এই ঘটনা স্বাভাবিকভাবেই আমাদের বিস্ময়ের উদ্রেক করে । শুধু তাই নয় , নেপোলিয়ন বিপ্লবী ফরাসী জনগণের উপর সম্রাটের একনায়কত্ব পুনঃস্থাপিত করেছিলেন । যে জনগণ সম্রাটতন্ত্রের অবসানের জন্য এত বড় বিপ্লবে সামিল হয়েছিলেন , তারাই আবার সম্রাট হিসেবে নেপোলিয়নকে স্বাগত জানিয়েছিলেন । 

আপাতদৃষ্টিতে বিস্ময়কর হলেও নেপোলিয়নের এই উত্থান কোন আকস্মিক বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় । সমসাময়িক ফ্রান্স ইউরোপের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং নেপোলিয়নের ব্যক্তিগত গুণাবলী বিশ্লেষণ করলেই তাঁর উত্থানের অনুকূলে উপাদান সমূহের সন্ধান পাওয়া যায় । 

বিপ্লব জনিত হতাশা থেকে মুক্তির ইচ্ছা  

বিপ্লব সম্পর্কে ফরাসী জাতির হতাশাবোধ নেপোলিয়নের উত্থানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল । আশা বিপ্লব জাগিয়েছিল , কিন্তু হতাশা নেপোলিয়নের উত্থানকে ত্বরান্বিত করেছিল । ‘ Short History of Europe ‘ গ্রন্থে বলা হয়েছে ” It was hope that made the Revolution , it was despair that led it at the feet of Nepoleon . ” : দশ বছরের নৈরাজ্য ফ্রান্সের রাজনৈতিক , সামাজিক , অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় সংগঠন ভেঙে দিয়েছিল । শাসনতান্ত্রিক ক্ষেত্রে একের পর এক পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছিল । রচিত হয়েছিল একাধিক সংবিধান । বারবার পরিবর্তিত হচ্ছিল সরকারী কাঠামো । কিন্তু কোনভাবেই দেশের রাজনৈতিক সুস্থিরতা আসেনি । সন্ত্রাসের শাসন শুরু হলে ফ্রান্সবাসী এই হতাশাবোধ সৃষ্টি করেছিল গভীর আতঙ্কের । 

এই হতাশা ও আতঙ্ক থেকে মুক্তিলাভের জন্য দেশবাসী তখন এমন একটা বিকল্পের চিন্তা করছিলেন , যা বিপ্লবজনিত শাসনতান্ত্রিক অস্থিরতার অবসান ঘটাবে এবং ব্যক্তিজীবনে নিরাপত্তাবিধানে সক্ষম হবে । এক্ষেত্রে নেপোলিয়নের অনন্য প্রতিভা জনগণকে আকৃষ্ট করে । ঐতিহাসিক টমসনের ভাষায় : “ বিপ্লবের দুরন্ত গতি নিঃশেষিত হওয়ায় সাংগঠনিক ও সামরিক প্রতিভা দীপ্ত সৈনিকের ক্ষমতা লাভের পথ প্রশস্ত হয় । ” 

ডাইরেক্টরীর ব্যর্থতা 

ফ্রান্সের সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নেপোলিয়নের ক্ষমতা লাভকে সহজতর করে দিয়েছিল । নেপোলিয়নের অভ্যুত্থানের মুহূর্তে ফ্রান্সে ছিল ডাইরেক্টরীর শাসন । কিন্তু বিপ্লবী ফ্রান্সে এতখানি অদক্ষ , অযোগ্য ও অকর্মণ্য শাসনব্যবস্থা বোধ হয় আর কোনটাই ছিল না । এঁদের দুর্বল শাসনের ফলে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ভীষণ বেড়ে যায় । 

একদিকে অতি বিপ্লবীদের কার্যকলাপ ও অন্যদিকে প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়াদের কারচুপির মাঝে এরা দিশেহারা হয়ে পড়ে । সেইসঙ্গে বৈদেশিক যুদ্ধের বিপুল ব্যয়ভার মেটাতে রাজকোষ শূন্য হয়ে যায় । ফলে খাদ্যাভাব ও দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি ঘটে । ডাইরেক্টরদের অমিতব্যয়িতা আর্থিক সংকটকে আরও গভীর করে । তাই সবশ্রেণীর মানুষই ডাইরেক্টরীর প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে । ডাইরেক্টরী মানুষকে নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তার পরিবর্তে অনিশ্চয়তা ও আর্থিক সংটের দিকে ঠেলে দিতে থাকে । 

অন্যদিকে নেপোলিয়ন তাদের শান্তি ও নিরাপত্তার সুনিশ্চিত আশ্বাস দেন । স্বভাবতই , জনগণ তাঁকে বিশ্বাস করে এবং তাঁর অভ্যুত্থানকে স্বাগত জানায় । ঐতিহাসিক রাইকারের মতে , “ ফ্রান্সের জনমানস রাজনৈতিক সংঘাত , বিরামহীন নির্বাচন , বিশৃঙ্খলা ও অর্থনৈতিক সংকটের জন্য বিপ্লবের প্রতি অশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিল । ” তাঁর ভাষায় : “ Public opinion was tired of political agita tion , tired of endless election , tired of disorders which has throttled the nation’s economic life . “

ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা 

নেপোলিয়নের অসাধারণ জনপ্রিয়তাও তাঁর একনায়কত্বে উত্থানের পথকে প্রশস্ত করেছিল । তিনি জন্মেছিলেন একজন সাধারণের বাড়ীতে । স্বভাবতই , ফ্রান্সের তৃতীয় সম্প্রদায়ের মানুষ নেপোলিয়নের সাথে একাত্মবোধ করতে পেরেছিল । ফলে সৈনিক হিসেবে তাঁর সামান্য সাফল্যেও জনগণ রোমাঞ্চিত বোধ করছিল । যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর উপর্যুপরি সাফল্য তাঁকে মহানায়কের মর্যাদায় ভূষিত করেছিল । 

তিনি ফ্রান্সের হারিয়ে যাওয়া সামরিক গৌরবকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন । টুঁলো বন্দর অবরোধ মুক্ত করা , কনভেশনকে রক্ষা করা , প্রথম শক্তিজোটকে ভেঙে দেওয়া প্রভৃতি কাজ তাঁকে অদ্বিতীয় গৌরবের অধিকারী করে । সেই সময় ঘরে ঘরে নেপোলিয়নের পূজা করে দেশের আশা আকাঙ্ক্ষা তাঁকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হতে থাকে । যখন ফ্রান্সের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় শক্তিজোট গঠিত হয় , তখন আতঙ্কিত ফরাসী জাতি নেপোলিয়নের মধ্যেই তাদের একমাত্র রক্ষকের প্রতিশ্রুতি দেখতে পায় । 

অনুকূল পরিস্থিতি

নেপোলিয়নের উত্থানে তাঁর ভাগ্যকেও অস্বীকার করা যায় না । ইতিহাসে ভাগ্যের কোন সরকারী স্বীকৃতি হয়ত নেই , কিন্তু বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে তিনি যেভাবে সাহায্য সহায়তা পেয়েছিলেন , তা কেবল ভাগ্যের কথাই মনে করিয়ে দেয় । থার্মিডোরীয় প্রতিক্রিয়ার নেতা বারাসের সাথে তাঁর সামান্য পরিচয় ছিল । 

কিন্তু জোসেফাইনকে বিবাহের সূত্রে নেপোলিয়ন বারাসের সক্রিয় সহায়তা লাভে সফল হন । জোসেফাইন বারাসকে বশীভূত করে নেপোলিয়নকে সৈনাপত্যলাভে সাহায্য করেন । আবার ডাইরেক্টরীর পতন ঘটাতে অন্যতম ডাইরেক্টর এ্যাবিসিয়েস নেপোলিয়নকে সাহায্য করেন । এই ধরনের রাজকীয় সহযোগিতা না পেলে নেপোলিয়নের ক্ষমতা দখল হয়ত এতটা সহজ হত না । 

ব্যক্তিগত দক্ষতা

নেপোলিয়ন তাঁর ব্যক্তিগত দক্ষতার দ্বারা সমসাময়িক পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ন করতে পেরেছিলেন । ফলে তিনি ঠিক সময়ে ঠিক পদক্ষেপ করেছেন । তিনি বুঝেছিলেন বিপ্লবের চরমপন্থার প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন ছিল না । কয়েকজন মুষ্টিমেয় নীতিবাগীশ লোকই বিপ্লবের চরম পরিণতি দেখতে ছিলেন । সাধারণ মানুষ বিপ্লবের আদর্শবাদের তুলনায় নিজেদের খাদ্য , পোশাক ও বাসস্থানের প্রতি বেশী আগ্রহী ছিল । 

নেপোলিয়ন একদা বলেছিলেন , “ ফরাসী জাতি সাম্য চায় , স্বাধীনতা নয় ” ( “ What the French people want is equality , not liberty ” ) । তিনি সাধারণ মানুষকে সেই সাম্যের নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন । তিনি ঘোষণা করেন যে , সাধারণ মানুষ যেরকম শাসনব্যবস্থা চায় , তা প্রবর্তন করাই আমার নীতি ‘ । ( ‘ My policy consists in governing men as they wish to be governed ‘ ) । তাঁর এই প্রতিশ্রুতি সাধারণ মানুষের মনের কথাকেই ব্যক্ত করে । 

সেনাবাহিনীর আনুগত্য 

১৭৯৯ খ্রীষ্টাব্দে ফ্রান্সে যেরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল , তাতে একজন সৈনিককে দেশের দায়িত্ব দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না । আর সেক্ষেত্রে নেপোলিয়ন ছিলেন প্রথম ও শেষ পছন্দ । তখন গোটা ফরাসীবাহিনীও বিপ্লবী ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়েছিল । যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের আত্মত্যাগের প্রেরণা বিপ্লব থেকেই পেয়েছিল । সুতরাং , দেশের প্রশাসনে সেনাবাহিনীর পছন্দ অপছন্দেরও একটা দিক ছিল । নেপোলিয়ন তাঁর অসীম রণদক্ষতা , ব্যক্তিত্ব , কঠোর শ্রম ও ত্যাগের মাধ্যমে সমস্ত সেনাবাহিনীর ‘ আদর্শ পুরুষে ’ পরিণত হয়েছিলেন । ফলে তাঁর ক্ষমতা লাভ কোনভাবেই বাধাপ্রাপ্ত হয়নি । 

সামগ্রিক ক্ষমতা 

সর্বোপরি একথা স্বীকার করতে হবে যে , কেবল অনুকূল পরিস্থিতি বা গণ হতাশা থেকে একজন মানুষের উত্থান সম্ভব নয় । সেক্ষেত্রে নেপোলিয়নের পরিবর্তে অন্য কেউ আসতে পারতেন । আসলে তাঁর অনন্য সাধারণ সামরিক প্রতিভা , উচ্চাকাঙ্ক্ষা , অন্তর্দৃষ্টি , ব্যক্তিত্ব ও স্বদেশচেতনা তাঁর প্রাথমিক উত্থানকে সম্ভব করেছিল । অর্থাৎ ‘ কনসাল ’ হতে পেরেছিলেন । 

তারপর তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতা , অভ্যন্তরীণ সংস্কার ও বৈদেশিক সাফল্য তাঁকে ফরাসীদের ‘ সম্রাট ’ হতে সাহায্য করে । ক্ষমতা দখল করা যায় , কিন্তু তাকে বহাল রাখার জন্য প্রতিভার প্রয়োজন সেই প্রতিভা নেপোলিয়নের ছিল । তাই স্বদেশের আপামর জনসাধারণ তাদের নেতা হিসেবে নেপোলিয়নকে বরণ করে নিয়েছিল । তাঁর অনন্য প্রতিভার ব্যাখ্যা করে ‘ Short History of Europe ‘ গ্রন্থে বলা হয়েছে : “ There burnt in him ( Nepoleon ) the flame of genius generals , troops and civilians fell under its spell . “

আরো পড়ুন : নেপোলিয়নের সংস্কার গুলি আলোচনা করো

নেপোলিয়নের পতনের মহাদেশীয় অবরোধ নীতি দায়িত্ব

তৃতীয় নেপোলিয়নের বৈদেশিক নীতি আলোচনা কর

তৃতীয় নেপোলিয়নের অভ্যন্তরীণ সংস্কার গুলি আলোচনা করো

তৃতীয় নেপোলিয়নের অবদান আলোচনা করো

error: Content is protected !!