রোবসপিয়ার কে ছিলেন

রোবসপিয়ার কে ছিলেন

ফরাসী বিপ্লবের অন্যতম নেতা ছিলেন রোবসপিয়ার ( ১৭৫৮ – ১৭৯৪ খ্ৰীঃ ) । ঐতিহাসিক ডেভিড টমসনের  মতে , “ রোবসপিয়ারের মধ্যে বিপ্লব প্রতিফলিত হয়েছিল । ফ্রান্সের বিপ্লবী নেতাদের মতে , তিনি ছিলেন স্মরণীয় এবং প্রতীকি । ” প্রকৃত অর্থেই ব্যক্তি রোবসপিয়ার ছিলেন সৎ , আদর্শবাদী ও নির্ভীক রাজনীতিবিদ । তাঁর চরিত্র ছিল সবরকম কলুষতা মুক্ত । 

রোবসপিয়ার বাল্যকালেই পিতা মাতাকে হারিয়ে এক বিশপের কাছে মানুষ হন । শিক্ষা সমাপনান্তে তিনি আইনজীবীর কাজ নেন । ১৭৮৯ খ্রীষ্টাব্দের সংবিধান সভার প্রতিনিধি হিসেবে তিনি রাজনীতির মঞ্চে প্রবেশ করেন । অতঃপর একের পর এক ঘটনার মধ্য দিয়ে তিনি ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করেন । সন্ত্রাসের শাসনকালে তিনি একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হন । 

রোবসপিয়ার রুশোর দার্শনিক তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন । তিনি সমষ্টির ইচ্ছাকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে বলে মনে করতেন । বিপ্লবকে রক্ষা করার জন্য তিনি কঠোরতম ব্যবস্থাগ্রহণেও দ্বিধা করতেন না । তাঁর মতে , ‘ জনতা যখন অত্যাচারিত হয় , তখন জনতাই তার প্রতিকার করে । শাসন স্বৈরাচারী হলে জনতার উচিত বিদ্রোহ করে তার প্রতিবিধান করা । এইভাবে তিনি জনতার নেতৃত্ব নিয়ে আইনসভাকে নিজের বশীভূত করেন । 

রোবসপিয়ার ছিলেন জ্যাকোবিন ক্লাবের অন্যতম নেতা । তাঁর প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের ফলেই সংখ্যালঘু জ্যাকোবিন দল জাতীয় সম্মেলনে ক্ষমতা দখল করতে সমর্থ হয় । বক্তা হিসেবে তিনি খুব দক্ষ ছিলেন না ঠিকই , কিন্তু তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা জনগণকে আকৃষ্ট করত । 

কনভেনশন যখন ইউরোপীয় যুদ্ধে অংশ নিতে আগ্রহী হয় , তখন একমাত্র রোবসপিয়ারই তার বিরোধিতা করেন । কারণ তাঁর বিশ্বাস ছিল যুদ্ধে ফ্রান্সের অর্থব্যয় হবে , দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে , সেনাবাহিনীর ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং পরিণতিতে বিপ্লব পিছিয়ে পড়বে । অবশ্য তাঁর চেষ্টা সফল হয়নি । যুদ্ধজনিত আপৎকালীন পরিস্থিতিতে যখন ‘ সন্ত্রাসের শাসন ’ শুরু হয় , তখন ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণ হয় তাঁর হাতে । দেশের বিপ্লবের স্বার্থে তিনি কঠোরতম শাসন প্রবর্তন করেন ।  

গণনিরাপত্তা সমিতির প্রধান হিসেবে তিনি চরমপন্থী হার্বাট ও তাঁর অনুগামীদের ক্ষমতাচ্যুত করেন । হার্বার্টকে গিলোটিনে হত্যা করা হয় । হার্বাট ছিলেন খ্রীষ্টধর্ম বিরোধী ও সমাজতন্ত্রী । এরপর আসে ডাণ্টনের পালা । ডাণ্টন ছিলেন মধ্যপন্থী । তিনি ও তাঁর অনুগামীরা সন্ত্রাসের শাসনের অবসান চাইছিলেন । রোবসপিয়ার ডাণ্টনের বিরুদ্ধে বিপ্লব বিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে তাঁকেও গিলোটিনে হত্যা করেন ।

এরপর রোবসপিয়ার নিরঙ্কুশভাবে সন্ত্রাস চালিয়ে যেতে থাকেন । তিনি একটি নতুন আইন জারি করে ( ১০ ই জুন , ১৭৯৪ খ্রীঃ ) সন্ত্রাসকে ‘ মহাসন্ত্রাসে ’ পরিণত করেন । এই আইনবলে অভিযুক্তদের আত্মরক্ষার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয় । এ ছাড়া তিনি ‘ নিম্নতম মজুরি আইন ’ , ‘ সর্বোচ্চ মূল্যের আইন ‘ প্রভৃতি জারি করেন । এই সময়ে রোবসপিয়ার তাঁর সামান্যতম সমোলোচককেও নির্দ্বিধায় গিলোটিনে পাঠান । ফলে সাত সপ্তাহে গিলোটিনে হত্যার সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় তেরো শ ।  

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য , রোবসপিয়ার একটি নতুন ধর্মও প্রচলনের চেষ্টা চালান । তিনি একজন পরম পুরুষ ( Supreme Being ) এর অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিলেন । যাই হোক , তাঁর নৃশংসতা ক্রমশ তাঁর শত্রুদের ঐক্যবদ্ধ করতে থাকে । জনগণও দীর্ঘকালীন সন্ত্রাসের ফলে নেতৃত্বের প্রতি বিদ্বিষ্ট হয়ে ওঠেন ।  

এমতাবস্থায় হার্বার্ট ও ডাণ্টনের অবশিষ্ট অনুগামীরা রোবসপিয়ারের শত্রুদের সাথে মিলিত হয়ে একটি গোপনে ষড়যন্ত্র রচনা করেন । এদের সঙ্গে হাত মেলায় বুর্জোয়া প্রতিবিপ্লবীরা । সাঁকুলাতরাও রোবসপিয়ারের কাছ থেকে সরে যায় । এরপর ২৭ শে জুলাই  , ১৭৯৪ খ্রীষ্টাব্দে , এক অভ্যুত্থানের দ্বারা রোবসপিয়ারের দীর্ঘ এবং কর্মময় জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে ।

আরো পড়ুন : ফ্রান্সে সন্ত্রাসের রাজত্ব বলতে কী বোঝো

থার্মিডোরীয় প্রতিক্রিয়া কী

সন্ত্রাসের রাজত্ব

জুলাই বিপ্লবের কারণ

error: Content is protected !!