ইতিহাস

রুশো কে ছিলেন

রুশো কে ছিলেন

জঁ-জাক রুসো ( ১৭১২ – ১৭৭৮ খ্রীঃ ) ছিলেন এক অন্যান্য প্রতিভার অধিকারী ও জনপ্রিয় চিন্তাবিদ । অষ্টাদশ শতকের রাজনৈতিক আদর্শের ইতিহাসে তাঁর প্রভাব সম্ভবত সর্বাধিক । ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন নিঃসঙ্গ , বন্ধুত্বকামী কিন্তু বন্ধুত্ব রক্ষার মানসিকতা তাঁর ছিল না । তাঁর চিন্তা ভাবনায় ক্যাভিনের প্রভাব বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয় । 

সাম্যের ভিত্তিতে সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলাই ছিল তাঁর মূল আদর্শ । ১৭৪৯ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত একটি ছোট প্রবন্ধে তিনি ফরাসী সমাজের অবক্ষয়ের ইতিহাস তুলে ধরেন । এর পর ধীরে ধীরে তাঁর চিন্তাজগৎ বিকশিত হতে থাকে । তিনি মনে করতেন সমাজের সাম্য ও স্বাধীনতা আবশ্যিক । তাঁর বক্তব্য হল , “ সামাজিক রাষ্ট্র তখনই সুবিধাজনক , যখন প্রত্যেকেরই কিছু থাকে এবং কারোরই বেশী থাকে না । ” সম্ভবত প্রাচীন রোমীয় সমাজ ব্যবস্থার দ্বারা রুশো অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন । 

বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট  ‘ ( La Contract Social ) এ রুশো তাঁর রাজনীতি ও রাষ্ট্র চিন্তার মূল কথা প্রকাশ করেন । তিনি বলেছেন , ‘ আদিম যুগে প্রকৃতির কোলে মানুষ ছিল সহজ ও সরল । তাদের চাহিদা ছিল ন্যূনতম । স্বভাবতই বিরোধ ছিল কম । কিন্তু সমাজ তৈরির সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টি হল জটিলতার । বিষয় সম্পত্তি থেকে সৃষ্টি হল অসাম্য এবং অসাম্য জন্ম দিল নিরাপত্তাহীনতার । অতঃপর জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তার কারণে সৃষ্টি হল চুক্তির । 

‘ চুক্তির তত্ত্ব ’ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রুশো বলেছেন , ‘ মানুষ জন্মে স্বাধীন , কিন্তু সর্বত্র সে শৃঙ্খলাবদ্ধ ‘ ( ‘ Man is born free , but everywhere he is in chain . ‘ ) । চুক্তির মাধ্যমেই কোন এক সময়ে বিভিন্ন মানুষের সম্মিলিত ইচ্ছার ফলেই সমাজ বা রাষ্ট্র এক নতুন সম্ভাবনা নিয়ে দেখা দিয়েছে । স্বেচ্ছাকৃত অলিখিত চুক্তি অনুযায়ীই সবার শাসনভার ন্যস্ত হয়েছে বিশেষ একজনের উপর । ব্যক্তিগত ইচ্ছার পরিবর্তে জয়লাভ করেছে সম্মিলিত ইচ্ছা । এইভাবে রুশো রাজার দৈবসত্ত্বের ( Divine origin ) পরিবর্তে প্রতিষ্ঠিত করেছেন জনগণের ইচ্ছা কে । 

তিনি এও বলেছেন , শাসক জনগণের ইচ্ছার নিকট দায়বদ্ধ । শাসক যদি সংখ্যা গরিষ্ঠের ইচ্ছানুযায়ী শাসন করতে ব্যর্থ হয় , তাহলে শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করার অধিকার জনগণের আছে । এইভাবে তিনি ‘ গণ-সার্বভৌমত্ব’কে প্রতিষ্ঠিত করেছেন । 

অবশ্য রুশোর বক্তব্যে কিছুটা আপাতবিরোধ লক্ষণীয় । তিনি ‘ গণ-সার্বভৌমত্বের ’ তত্ত্বের পাশাপাশি একক অধিনায়কত্বের প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেছেন । এমনকি শান্তি ও নিরাপত্তার খাতিরে এক রাষ্ট্রে একটিমাত্র ধর্মের অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেছেন । প্রয়োজনে অস্ত্রের জোরে একটিমাত্র ধর্মকে চাপিয়ে দেওয়ার উপরেও তিনি জোর দিয়েছেন । 

আসলে যুক্তিবাদের চেয়ে মানুষের স্বাভাবিক বৃত্তিকেই রুশো প্রাধান্য দিতে চেয়েছেন । তাঁর সামাজিক তত্ত্ব ছোট ভৌগোলিক এলাকার পক্ষেই উপযুক্ত । সম্ভবত জেনেভার নগর প্রজাতন্ত্রের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি সামাজিক চুক্তি মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন ।

যাই হোক , ফ্রান্স এবং ইউরোপে রুশোর প্রভাব ছিল অসীম । ফরাসী বিপ্লবের প্রাথমিক পর্বে রুশোর রচনা নিপীড়িত ফরাসী জাতিকে বিশেষ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল । তাঁর সততা ও আদর্শ অষ্টাদশ শতকের চিন্তাজগতে এক নতুন চেতনার সৃষ্টি করেছিল । পুরাতন ব্যবস্থার ( Old Regime ) মূলে কুঠারাঘাত করে মানুষকে স্ব-মর্যাদায় উন্নীত করার জন্য বহু শতাব্দী পরেও তাঁর স্মৃতি জনমানসে অম্লান হয়ে আছে । 

আরো পড়ুন : ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের ভূমিকা

ফরাসি বিপ্লবের ফলাফল আলোচনা কর

error: Content is protected !!