সাহিত্যে নবজাগরণের প্রভাব
Contents
সাহিত্যে নবজাগরণের প্রভাব
নবজাগরণের যুগে প্রাচীন গ্রিক ও রোমানে জ্ঞান বিজ্ঞান ব্যাপক চর্চার ফলে তার জীবনমুখী প্রভাব সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে । এর ফলে ইটালি , স্পেন , ফ্রান্স , হল্যান্ড সর্বত্রই এক নতুন সাহিত্যের জন্ম হয় । প্রথমে ল্যাটিন ভাষায় সাহিত্য সাধনা শুরু হলেও ক্রমে আঞ্চলিক ভাষা সাহিত্য , দর্শন ও বিজ্ঞান চর্চার বাহন হয়ে ওঠে ।
ইটালীয় সাহিত্য
ইটালির সাহিত্যে দান্তে , পেত্রার্ক , বোকাচ্চিও , মেকিয়াভেলি প্রমুখ বিশ্ববন্দিত পণ্ডিতদের অবদান ছিল অপরিসীম ।
আলঘিয়েরী দান্তে :
ইটালির আদি কবি এবং মধ্যযুগীয় পাশ্চাত্য সাহিত্যের মহৎ কাব্যের স্রষ্টা আলঘিয়েরী দান্তে [ 1265-1321 খ্রি. ] ছিলেন নবজাগরণের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক । ফ্লোরেন্সে এক অভিজাত পরিবারে তাঁর জন্ম । নবজাগরণের যুগে তিনি ছিলেন ইটালি তথা ইউরোপীয় সাহিত্যের অগ্রদূত । আঞ্চলিক টাস্কান ভাষাতেই তিনি সাহিত্য সাধনা করেছিলেন । টাস্কান ভাষায় তাঁর রচিত অমর কাব্য ডিভাইন কমেডি বিশ্ব সাহিত্যের একটি অমূল্য সম্পদ । দান্তে তাঁর রচনায় স্বর্গ ও নরকের রূপকের আড়ালে ন্যায় অন্যায়ের বিরোধের বাস্তব চিত্র অঙ্কন করেছেন । দান্তের সাহিত্য সৃষ্টি মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের মধ্যে সেতু বন্ধন করেছিল ।
ফ্রান্সিসকো পেত্রার্ক :
মানব প্রেমিক কবি ফ্রান্সিসকো পেত্রার্ক [ 1304-1374 খ্রি. ] ছিলেন নবজাগরণের মূর্ত প্রতীক ইটালির আরতসো নগরীতে তাঁর জন্ম । বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালে দেশ বিদেশ ভ্রমণকালে তিনি বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দু’শ প্রাচীন গ্রিক ও লাতিন পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করেছিলেন । এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সিসেরোর পত্রাবলী [ Cicero’s letters ] । দান্তের মতো ইটালির আঞ্চলিক টাস্কান ভাষায় তিনি সাহিত্য রচনা করেছিলেন । তাঁর সাধনার বিষয় ছিল প্রকৃতিপ্রেম ও সৌন্দর্য । তিনি ছিলেন চতুর্দশপদী কবিতা [ Sonnet ] –র জনক । তাঁর রচনায় সমসাময়িক সামাজিক রীতিনীতি ও জীবন যাত্রার বিরুদ্ধে তীব্র কটাক্ষ রয়েছে । তাঁর বিখ্যাত গীতিকাব্য লোরা তাঁকে সাহিত্য জগতে অমর করে রেখেছে ।
জিওভানি বোকাচ্চিও :
ইউরোপীয় গদ্য সাহিত্যের জনক রূপে স্বীকৃত বোকাচ্চিও [ 1313-1375 খ্রি. ] ছিলেন পেত্রার্কের ঘনিষ্ট বন্ধু ও সার্থক শিষ্য । তাঁর রচিত ডেকামেরন নামে গল্প গ্রন্থটি বিশ্ব সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ । এতে একশটি গল্প রয়েছে । সুন্দর ও সৌখিন প্রেমের কাহিনি নিয়ে তিনি তাঁর অমর সাহিত্য সৃষ্টি করেন । এছাড়া গ্রিক অন্ধ কবি হোমার রচিত দু’টি মহাকাব্য ইলিয়াড ও ওডিসি ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করে তিনি দেশবাসীর সমাদর অর্জন করেন ।
নিকোলো মেকিয়াভেলি :
রেনেসাঁস যুগের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ছিলেন নিকোলো মেকিয়াভেলি [ 1469-1527 খ্রি. ] । ফ্লোরেন্সের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে তাঁর জন্ম । তিনি ছিলেন আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক । তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল দি প্রিন্স । এই গ্রন্থে তিনি রাজতন্ত্রকে সমর্থন করে বলেন যে , ‘ রাষ্ট্র হবে ধর্ম নিরপেক্ষ , স্বাধীন ও সার্বভৌম ‘ । তাঁর মতে , ইতিহাস অতীতের ভুল ভ্রান্তি সংশোধন করে বর্তমানকে সঠিক পথে চলতে সাহায্য করে । তাঁর অপর এক প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হল ফ্লোরেনটাইন হিস্ট্রি ।
আরো পড়ুন : রেনেসাঁস বা নবজাগরণ বলতে কী বোঝো
ইংরেজি সাহিত্য
ইংরেজি সাহিত্য যাঁদের অবদানে সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁদের অন্যতম হলেন চসার , স্পেন্সার , শেক্সপিয়র এবং ফ্রান্সিস বেকন ।
জিওফ্রে চসার :
প্রথম এলিজাবেথীয় যুগে সাহিত্য জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক ও ইংরেজি কবিতার জনক ছিলেন জিওফ্রে চসার [ 1340–1400 খ্রি. ] । তিনি ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের প্রথম ‘ জাতীয় কবি ‘ । তাঁর রচিত দ্য ক্যান্টারবেরি টেলস সাহিত্য জগতে আজও অমূল্য সম্পদরূপে স্বীকৃত । তিনি তাঁর গ্রন্থে প্রকৃতির সঙ্গে রক্ত মাংসে গড়া মানুষের সম্পর্কের সুন্দর চিত্র তুলে ধরেছেন ।
এডমন্ড স্পেন্সার :
সৌন্দর্যের পূজারী এডমন্ড স্পেন্সার [ 1552-1599 খ্রি. ] ছিলেন ষোড়শ শতাব্দীর ইংল্যান্ডের এক প্রখ্যাত কবি । ফরাসি কবিদের মতো তাঁর কাব্যের বিষয়বস্তু ছিল প্রেম ও প্রকৃতি । তাঁর লেখা দ্য ফেয়ারি কুইন কাব্যগ্রন্থ ইংরেজি সাহিত্যের অনবদ্য গ্রন্থ ।
উইলিয়াম শেক্সপিয়র :
বিশ্ব সাহিত্যের অমর নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়র [ 1564-1616 খ্রি. ] ছিলেন মানবতাবাদের মহত্তম রূপকার । তিনি ৩৭ টি নাটক , ২ টি দীর্ঘ কাব্য এবং ১৫৪ টি সনেট রচনা করেছিলেন । তাঁর নাটকগুলিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়— মিলনান্তক ( কমেডি ) , বিয়োগান্তক ( ট্রাজেডি ) এবং ঐতিহাসিক । মিলনান্তক নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য — মার্চেন্ট অব ভেনিস , কমেডি অব এররস , দ্য টেমপেস্ট । বিয়োগান্তক নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য — হ্যামলেট , ম্যাকবেথ , ওথেলো , কিং লিয়ার প্রভৃতি । ঐতিহাসিক নাটক কিং জন , রিচার্ড দি থার্ড প্রভৃতি ।
তাঁর সাহিত্য জীবন মানুষের জয়গানে মুখর । লোভ , হিংসা বা ঈর্ষা নয় তাঁর নাটক ভালোবাসা আর বাঁচবার বাসনায় ভরপুর ।
ফ্রান্সিস বেকন :
শেক্সপিয়রের সমসাময়িক মনীষী ফ্রান্সিস বেকন [ 1561–1626 খ্রি. ] ছিলেন একাধারে দার্শনিক , বৈজ্ঞানিক ও সাহিত্যিক । তাঁর দর্শন চিন্তা বিজ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল । তাই তাঁকে পরীক্ষামূলক দর্শনের জনক বলে অভিহিত করা হয় । তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাবলী এসেজ , নোভাম অর্গানাম , অ্যাডভান্সমেন্ট অব লার্নিং প্রবন্ধগুলি আজও সর্বত্র সাদরে সমাদৃত ।
স্পেনীয় সাহিত্য
সারভান্তেস :
স্পেনের নবজাগরণের প্রবর্তক হলেন সারভান্তেস [ 1547–1616 খ্রি. ] । তাঁর হাস্য ও ব্যঙ্গাত্মক কবিতা ডন কুইকজোট গ্রন্থে তিনি ব্যঙ্গ বিদ্রূপের সাহায্যে মধ্যযুগের অভিজাতদের ভণ্ডামিকে জনসমক্ষে তুলে ধরেন ।
ফরাসি সাহিত্য
ফ্রাঁসোয়া রাবেলে :
ফ্রাঁসোয়া রাবেলে [ 1495-1553 খ্রি. ] ছিলেন ফ্রান্সের নবজাগরণের মূর্ত প্রতীক । তিনি তাঁর প্যান্টগ্রুয়েল ও গারগান্টুয়া গ্রন্থে মধ্যযুগীয় সংকীর্ণ জীবনের নিন্দা করে আনন্দময় জীবনের কথা বলেন ।
আরো পড়ুন : শিল্পে নবজাগরণের প্রভাব আলোচনা কর