ধর্ম সংস্কার আন্দোলনে মার্টিন লুথারের ভূমিকা
Contents
ধর্ম সংস্কার আন্দোলনে মার্টিন লুথারের ভূমিকা
ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম নায়ক ছিলেন জার্মানির মার্টিন লুথার [ 1483–1546 খ্রি. ] । 1483 খ্রিস্টাব্দে উত্তর জার্মানির ইসিলবেন গ্রামে এক কৃষক পরিবারে তাঁর জন্ম । এরফুর্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন ও ধর্মশাস্ত্রে পাণ্ডিত্য অর্জনের পর 1504 খ্রিস্টাব্দে তিনি উইটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিযুক্ত হন । পরে অগাস্টাইন ভ্রাতৃ সংঘ নামে এক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সদস্য হিসাবে সন্ন্যাসীর জীবন বরণ করেন । 1510 খ্রিস্টাব্দে লুথার খ্রিস্ট ধর্মের কেন্দ্রস্থল রোম ভ্রমণকালে ধর্ম যাজকদের অনাচার ও দুর্নীতি লক্ষ করেন এবং গভীরভাবে মর্মাহত হন ।
মুক্তি পণ বিক্রি
এই সময় রোমের সেন্ট পিটার গির্জা সংস্কারের জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে পোপ জন টেটজেল নামে এক ধর্ম যাজককে জার্মানিতে পাঠান । টেটজেল জার্মানিতে ধর্মভীরু মানুষদের কাছে ‘ ইন্ডালজেন্স ’ বা ‘ মুক্তি পত্র ‘ বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করতে থাকেন । টেটজেল ঘোষণা করেন — গির্জার জন্য অর্থ দান করলে দাতা পাপ মুক্ত হবে । অধিক অর্থ সংগ্রহের জন্য তিনি ঘোষণা করেন যে , এখন থেকে ‘ ক্ষমা পত্র ’ কিনে রাখলে ভবিষ্যতে পাপ করলে তা থেকেও মুক্তি পাওয়া যাবে ।
লুথারের প্রতিবাদ
বাইবেলের প্রতি আদর্শনিষ্ঠ মার্টিন লুথার এই ঘৃণ্য প্রচারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেন । 1517 খ্রিস্টাব্দে তিনি এই ক্ষমাপত্রের বিরুদ্ধে ল্যাটিন ভাষায় 95 টি অভিযোগ লিখে উইটেনবার্গ গির্জার দেওয়ালে ঝুলিয়ে দেন । এটি পঁচানব্বই গবেষণা পত্র নামে পরিচিত । লুথার ঘোষণা করেন , অর্থের বিনিময়ে পাপমোচন হয় না , অনুতাপই হল পাপমোচনের প্রকৃত পথ । লুথারের এই প্রতিবাদ জার্মানির সাধারণ মানুষকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল ।
1520 খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টধর্মের মূল নীতি ব্যাখ্যা করে তিনি ব্যাবিলোনিয়ান ক্যাপটিভিটি নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন । এই গ্রন্থের মাধ্যমে তিনি বলেন — সৎ খ্রিস্টান মাত্রই ঈশ্বরের সন্তান । সুতরাং পোপ ভগবানের প্রতিনিধি তা দাবি করতে পারেন না । তাছাড়া তিনি ভূমিদাস প্রথার তীব্র নিন্দা করে বলেন বাইবেল অনুযায়ী সম্পত্তিতে সকল মানুষের সমান অধিকার । লুথারের এই গ্রন্থ তাঁর শিষ্যদের কাছে ‘ দ্বিতীয় বাইবেল ‘ নামে পরিচিত । ক্যাথলিক চার্চের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন বলে লুথারের আন্দোলনকে প্রোটেস্টান্ট আন্দোলন বলা হয়ে থাকে ।
ওয়ার্মসের ধর্মসভা
লুথারকে শাস্তি দেবার জন্য তদানীন্তন পোপ দশম লিওর নির্দেশে ‘ পবিত্র রোমান সম্রাট ’ পঞ্চম চার্লস 1521 খ্রিস্টাব্দে জার্মানির ওয়ার্মস শহরে এক ধর্মসভা আহ্বান করেন । এই সভায় লুথারকে ‘ ধর্মদ্রোহী ‘ আখ্যা দেওয়া হয় । কিন্তু সৌভাগ্য যে , জার্মানির কয়েকজন রাজা ও বিশাল সংখ্যক জনগণ লুথারকে সমর্থন করেন । স্যাক্সনির রাজা ফ্রেডারিক লুথারকে আশ্রয় দেন । ইতিমধ্যে জার্মানিতে আধুনিক মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের ফলে লুথারের মতবাদ সমগ্র জার্মানিতে ছড়িয়ে পড়ে । লুথারের এই আন্দোলনের ফলে সমগ্র খ্রিস্টান জগৎ দু’টি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে ।
১. লুথারের সমর্থকরা ক্যাথলিক চার্চের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন বলে তারা প্রোটেস্টান্ট নামে পরিচিত হয় ।
২. রোমান পোপের অনুগামীরা বা প্রাচীন পন্থীরা ক্যাথলিক নামে পরিচিত হয় ।
মার্টিন লুথারের মতাদর্শ
লুথারে সংস্কারপন্থী মতাদর্শে কেন্দ্রের ছিল দুইটি তত্ত্ব―
( ক ) সবাই নিজের পুরোহিত এবং
( খ ) ঈশ্বর বিশ্বাসই মুক্তির একমাত্র পথ ।
লুথার ঘোষণা করেন ঈশ্বরের সঙ্গে সংযোগের জন্য ধর্ম বিশ্বাসী মানুষের কোন মধ্যবর্তীর প্রয়োজন নেই । প্রত্যেকেই নিজেই নিজের পুরোহিত । মার্জনা পত্র ( indulagence ) এর বিরোধিতা প্রসঙ্গে লুথার বলেন , পুন্য লাভের জন্য কোন দান ধ্যান , আচার অনুষ্ঠান নিষ্প্রয়োজন । করুণাময় ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস রাখলেই মানুষের মুক্তি সম্ভব । উটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসাবে তাঁর বিভিন্ন বক্তব্য ও বিশ্লেষণের ভিত্তিতে অনেকেই তাকে মানবতাবাদী পণ্ডিত বলে মনে করেন ।
আন্দোলনের প্রসার
জার্মানীতে যে আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল জার্মান সংলগ্ন জার্মান ভাষাভাষী অঞ্চলে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে । সুইজারল্যান্ড ও অস্ট্রিয়ার মধ্য দিয়ে তা প্রসারিত হয় পশ্চিম ও দক্ষিণ ইউরোপে । অবশ্য স্থানভেদে আন্দোলনের গতি ও সাফল্যের তারতম্য ছিল । এই সাফল্য অনেকটা নির্ভরশীল ছিল সংস্কারকামী যাজকদের সাথে আঞ্চলিক রাজশক্তির সম্পর্কের উপর ।
জার্মানীতে ধর্ম সংস্কার আন্দোলন ঘটেছিল দ্রুততার সাথে , কিন্তু ইংল্যাণ্ড , সুইডেন , নরওয়ে প্রভৃতি দেশে প্রাথমিক পর্বে সংস্কার আন্দোলনের গতি ছিল শ্লথ । অবশ্য পরে রাজশক্তির আনুকূল্যেও এইসব দেশেও সংস্কার আন্দোলন সফল হয়েছিল । মার্টিন লুথার ক্ষুব্ধ কৃষকশ্রেণী ও রাজন্যবর্গের সমর্থনে যে দ্রুততার সাথে সাফল্য পেয়েছিলেন অন্যান্যদের ক্ষেত্রে তার গতি ছিল শ্লথ ।
প্রাথমিক ভাবে রাজা পঞ্চম চার্লস edict of worms দ্বারা লুথারকে আইন বহির্ভূত ঘোষণা করলেও শেষ পর্যন্ত রাজন্যবর্গের আনুকূল্যে লুথার প্রতিবাদী সংগ্রাম গড়ে তোলেন । এইভাবে জার্মানীতে তথা ইউরোপে ধর্মশ্রেণিক বিভাজন সৃষ্টি হয় ।
একদিকে ছিলেন প্রতিবাদী মতের অনুগামী রাজন্যবর্গ এবং অন্যদিকে ক্যাথেলিক ধর্মের ধারক রোমান পোপ ও পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য । মার্টিন লুথার পোপ ও সম্রাটের বহুজাতিক রাজনৈতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে যেভাবে আঞ্চলিক রাজশক্তিকে সংগঠিত করেছিলেন । তার ফলে প্রতিবাদী ধর্মমত জাতীয় রাজতন্ত্রের উত্থানের পথ প্রশস্ত করেছিল ।
আরো পড়ুন : ফরাসি বিপ্লবের ফলাফল আলোচনা কর
নেপোলিয়নের ধর্ম মীমাংসা চুক্তি বা কনকর্ডাট