ফরাসি সংবিধান সভার ত্রুটি 

ফরাসি সংবিধান সভার ত্রুটি 

ফ্রান্সের ইতিহাসে সংবিধান সভার গুরুত্ব অসীম । সামন্ততন্ত্র , ভূমিদাস প্রথা , বৈষম্যমূলক কর ব্যবস্থা প্রভৃতির বিলোপ সাধন করে নতুন সংবিধান এক প্রশংসনীয় ও দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল । কিন্তু তা সত্ত্বেও এই সংবিধানের বহু ত্রুটি পরিলক্ষিত হয় । 

প্রথমত , স্বাধীনতা ও সাম্যের জয় ঘোষণা সত্ত্বেও নতুন সংবিধানে নাগরিকদের সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় — এই দু’ভাগে বিভক্ত করে প্রায় ত্রিশ লক্ষ সাধারণ মানুষকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয় । এক্ষেত্রে বুর্জোয়া শ্রেণীর নীচ স্বার্থ চিন্তা খুব স্পষ্ট । যে তৃতীয় সম্প্রদায়ভুক্ত সাধারণ মানুষ বিপ্লবের প্রধান ধারক ছিল , নতুন সংবিধান তাদের মাথায় পুনরায় গুরুত্বহীন নাগরিকের কালো মুকুট পরিয়ে দেয় । 

পূর্বে ছিল যাজক , অভিজাত ও সাধারণ— এই তিনটি সামাজিক শ্রেণীবিভাগ । নতুন সংবিধান সেক্ষেত্রে আর্থিক ক্ষমতার ভিত্তিতে শ্রেণীবিভাগ করে দেয় । তাই থমসন ( Thomsom ) বলেছেন : ” In place of clergy , nobility and the common , the constitution brought the pound , shilling and the pence . 

দ্বিতীয়ত , এই সংবিধান অনুযায়ী আইনসভা পেয়েছিল দায়িত্বহীন ক্ষমতা , আর রাজা পেয়েছিলেন ক্ষমতাহীন দায়িত্ব । ক্ষমতা বিভাজন নীতির প্রতি অন্ধ আস্থাবশত সংবিধান সভা আইন বিভাগ ও প্রশাসনকে পঙ্গু ও বিশৃঙ্খল করে তুলেছিল । বিভিন্ন বিভাগের ক্ষমতা বিভাজনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করাও যে আবশ্যিক , —এই সত্য সংবিধান প্রণেতারা উপলব্ধি করতে পারেন । নৈতিকতা ও বাস্তবতার দ্বন্দ্ব একটা প্রশাসনিক অচলাবস্থার সম্ভাবনা তৈরি করেছিল । 

তৃতীয়ত , অতি বিকেন্দ্রীকরণের ফলে দেশের সংহতি বিনষ্ট হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল । প্রদেশগুলির উপর কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ সুনির্দিষ্ট ছিল না । পরন্তু নির্বাচনের মাধ্যমে অযোগ্য ও অসৎ লোক প্রশাসনে আসার ফলে প্রশাসনও দুর্বল হয়ে পড়েছিল । প্রদেশগুলি ছিল যেন এক একটি স্বতন্ত্র প্রজাতন্ত্র । 

চতুর্থত , ক্যাথলিক প্রধান দেশে পোপের ক্ষমতা হ্রাসের ফল শুভ হয়নি । ফলে বহু সাধারণ ধর্মভীরু মানুষ বিপ্লব থেকে সরে এসেছিল । কাগজী নোট প্রচলনের সিদ্ধান্তও কার্যকরী হয়নি । 

পঞ্চমত , সংবিধান সভার সদস্যরা আইন সভার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার ফলে তাদের অভিজ্ঞতা থেকে নতুন আইন সভা বঞ্চিত হয়েছিল ।

সংবিধান সভার এইসব ত্রুটি থাকলেও সংবিধান সভার কৃতিত্বকে সঙ্কুচিত করা উচিত নয় । ফ্রান্সের তৃতীয় সম্প্রদায়ের জটিল ও পরস্পর বিরোধী চরিত্রের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের কাজ ছিল যথেষ্ট কঠিন । কেবল সংবিধান রচনার মাধ্যমে সকলের স্বার্থরক্ষা করা সম্ভব ছিল না । ঐ রাজতন্ত্রের ঐতিহ্যের প্রতি ফ্রান্সের সাধারণ মানুষের দুর্বলতার দিকটিও অস্বীকার করা সম্ভব ছিল না । এত সমস্যার মাঝেও মানবতাবাদ ও উদারতাবাদ প্রতিষ্ঠার প্রয়াস হিসেবে সংবিধান সভার কৃতিত্ব স্মরণীয় ।

আরো পড়ুন : ফরাসি সংবিধান সভার কার্যাবলি

ভারতের সংবিধান সভা কিভাবে গঠিত হয়

ব্যক্তি ও নাগরিক অধিকার পত্রের ঘোষণা

error: Content is protected !!