ফরাসি বিপ্লবের ফলাফল আলোচনা কর

Contents

ফরাসি বিপ্লবের ফলাফল আলোচনা কর

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে ফরাসি বিপ্লবকেই আধুনিক ইউরোপের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে উল্লেখ করা যায় । নিঃসন্দেহে এই বিপ্লব ছিল মানবজাতির তথা ইতিহাসের পট পরিবর্তনের অগ্রদূত । তাই এর প্রভাব ছিল গভীর এবং সুদূরপ্রসারী । বিপ্লবের কম্পন কেবল ফ্রান্সে নয় , অনুভূত হয়েছিল ইউরোপের অন্যত্রও । কেবল ফরাসি জাতি নয় , এই বিপ্লবের আলোকে আলোকিত হয়েছিল বিশ্বের অন্যান্য জাতিও । 

পুরাতন ব্যবস্থার অবস্থান 

ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম হল সামন্তশ্রেণী , স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র ও সুবিধাভোগী ক্যাথলিক চার্চ – পূর্বতন সমাজ ব্যবস্থার এই তিনটি প্রধান স্তম্ভের বিলোপ সাধন । দেশের সমাজ , রাষ্ট্রনীতি ও অর্থনীতি — প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিপ্লব মৌলিক পরিবর্তনের সূচনা করে । বিপ্লবের আঘাতে পূর্বতন সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে । অভিজাত ও যাজকদের বিশেষ অধিকার বিলুপ্ত হয় । প্রতিষ্ঠিত হয় মানুষের সাম্যের অধিকার । 

রাজতন্ত্রের অবসান 

বিপ্লবের আঘাতে ফ্রান্সে বুরবোঁ রাজতন্ত্রের ভিত্তি শিথিল হয়ে পড়ে । দৈবসত্ত্বের তত্ত্ব ভ্রান্ত প্রমাণিত হয় । রাষ্ট্র ক্ষমতা জনগণের ঐক্য ও শুভেচ্ছার উপর নির্ভরশীল — এই ধারণা দৃঢ় ভিত্তি পায় । অতঃপর ফ্রান্সে রাজতন্ত্র স্থাপনের প্রয়াস দেখা গেলেও , তা স্থায়িত্ব লাভ করেনি । এইভাবে দেশে প্রজাতন্ত্রের পথ প্রশস্ত হয় । 

আরো পড়ুন : ফরাসি বিপ্লবের সামাজিক কারণ গুলি আলোচনা করো

ফরাসি বিপ্লবের অর্থনৈতিক কারণ গুলি আলোচনা করো

চার্চের কর্তৃত্বের অবসান 

রাজতন্ত্রের অবসানের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি স্বরূপ রাজতন্ত্রের দুটি হাত – চার্চ ও অভিজাতদের পঙ্গুতাও অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায় । ফরাসি চার্চ ছিল যেন ‘ রাষ্ট্রের ভিতর রাষ্ট্র ’ ( ‘ state within state ‘ ) । যাজকদের ছিল বিশেষ সুযোগ সুবিধা , স্বাধীন আর্থিক প্রশাসন ও বিশাল ভূ সম্পত্তি । বিপ্লবের ফলে চার্চ ভূ সম্পত্তি হারাল , যাজকরা হারাল অতিরিক্ত সুযোগ সুবিধা , পোপ হারান তাঁর সর্বময় কর্তৃত্ব । অতঃপর চার্চ পরিণত হয় শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে । 

অভিজাত তন্ত্রের বিলোপ 

চার্চ তথা যাজকদের মত ক্ষতিগ্রস্ত হয় অভিজাতরাও । বিপ্লবের ফলে সামন্ততন্ত্রের ধারক ও বাহক ফরাসি অভিজাতশ্রেণী তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও সামাজিক মর্যাদা হারিয়ে পরিণত হল শুধু নাগরিকে ।  

বিপ্লবের বিভিন্ন পর্যায়ে অভিজাতদের বিশেষ অধিকার একটু একটু করে কেড়ে নেওয়া হতে থাকে । এতকাল তারা রাজকোষে কর প্রদান থেকে রেহাই পেয়ে যেত । অতঃপর তা বন্ধ হয়ে যায় । বিশেষ নাগরিকের মর্যাদা হারিয়ে তারাও অন্যান্য নাগরিকদের মত নাগরিক কর্তব্য পালনে বাধ্য হয় । সরকারী চাকরিতে বংশ মর্যাদার পরিবর্তে যোগ্যতাকে নিয়োগের মাপকাঠি করার ফলে সেক্ষেত্রেও তাদের একচেটিয়া আধিপত্য বিনষ্ট হয় । 

অবশ্য বিপ্লবোত্তর ফ্রান্সের নতুন সমাজ ব্যবস্থায় বহু অভিজাতই নিজেদের মানিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিল । তাদের আর্থিক অবস্থাও খারাপ ছিল না । তবে তাদের পূর্বতন সামাজিক আধিপত্য অবশ্যই ফিরে আসেনি । 

বুর্জোয়াদের আধিপত্য স্থাপন 

১৭৮৯ খ্রীঃ এর ফরাসি বিপ্লবের অগ্রদূত ছিল বুর্জোয়া মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় । স্বভাবতই তাদের সামাজিক , রাজনৈতিক ও আর্থিক জীবনে বিপ্লবের প্রভাব ছিল অসীম । লেফেভর এর মতে , “ বিপ্লবের ফলে বুর্জোয়া শ্রেণীর অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য পরিবর্তিত হয়েছিল । ” যে বুদ্ধিজীবী মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় বিপ্লবের প্রধান মাথা ছিল , কার্যতঃ তাদের অবস্থার বিশেষ উন্নতি হয়নি ।  

কিন্তু শিল্পপতি বা ব্যবসায়ীশ্রেণী ফাটকাবাজি করে বা যুদ্ধের সময় খাদ্যদ্রব্য বা অন্যান্য সামগ্রী সরবরাহ করে নিজেদের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল । এমনকি ছোট ছোট ব্যবসায়ী , দোকানদার , কারিগর বা ঠিকাদাররাও পরিস্থিতির সুযোগে নিজেদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটিয়ে বুর্জোয়া শ্রেণীর স্তর বিন্যাসের উপরের দিকে উঠেছিল । এই ভুঁইফোড় ধনীরাই নতুন সমাজের প্রতিভূ । 

কৃষকদের অবস্থা 

ফরাসি কৃষকদের অবস্থারও বিশেষ পরিবর্তন ঘটেছিল । সামন্ততন্ত্র ও বিভিন্ন করের বিলোপ ঘটায় কৃষকদের প্রভূত উপকার হয় । কৃষকদের যৌথভাবে জমি ক্রয়ের আইন পাস হওয়ার ফলে বহু কৃষক উপকৃত হয়েছিল । তবে এতে উপকৃত হয়েছিল শুধুমাত্র বড় বা মাঝারি কৃষকেরা । দরিদ্র কৃষকদের অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন ঘটেনি । লেফেভর এর মতে , গ্রামাঞ্চলে ‘ বুর্জোয়া কৃষকদেরই ‘ আধিপত্য ছিল । তাছাড়া , ভোটদানের ক্ষেত্রে সম্পত্তির অধিকার স্বীকৃত হওয়ার ফলে বা মুদ্রাস্ফীতি জনিত মূল্যবৃদ্ধির ফলে সবথেকে বিপদে পড়েছিল এরাই ।

জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা 

বিপ্লব ফ্রান্সে জাতীয় ঐক্য নিয়ে আসে । জাতীয়তাবাদ নতুন সজ্জায় ভূষিত হয় । এতকালের প্রচলিত ‘ এক রাজা ও এক রাষ্ট্র ‘ জাতীয়তাবাদের এই সংজ্ঞার পরিবর্তে “ এক ভাষা , এক কৃষ্টি ও অভিন্ন আশা – আকাঙ্ক্ষারই জাতির বৈশিষ্ট্য ” —এই ভাবনা বিকাশ লাভ করে । বিপ্লবের ফলে ‘ এক ও অখণ্ড জাতীয় চেতনা জাগরিত হয় । সারা দেশে একই ধরনের শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করে এবং অভ্যন্তরীণ শুল্ক ব্যবস্থার বিলোপ করে প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ঐক্যের ভিত্তি রচনা করা হয় । জাতীয় সৈন্যবাহিনী জাতীয় চেতনা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে । 

গণতন্ত্রের বিকাশ 

বিপ্লবের আর একটি বৈশিষ্ট্য হল স্বৈরতন্ত্রের পরিবর্তে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতার বিকাশ । রুশোর সামাজিক মতবাদ অনুযায়ী জনগণ শাসনে অংশগ্রহণের অধিকার ও স্বাধীনতা সমূহ । অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিপ্লব স্থাপন করে সাম্য ও স্বাধীনতা , আয় ও করদানের ক্ষেত্রে সবশ্রেণীর মানুষকে দেওয়া হয় সমান অধিকার ও দায়িত্ব । 

মনোজগতে পরিবর্তন 

শিক্ষার ক্ষেত্রেও বিপ্লবের অবদান উল্লেখযোগ্য । শিক্ষার লোকীকরণ ও আধুনিকীকরণ হয় । শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে চার্চের একক আধিপত্য বিলুপ্ত হয় । বিপ্লব নাড়া দিয়েছিল চিন্তাজগতেও । সাহিত্যিক , দার্শনিক , শিল্পী আরও বেশী সংখ্যায় হয়েছিলেন বিপ্লব সচেতন । পরিবর্তনের ও যুক্তিবাদের প্রবর্তনে তারা স্ব স্ব লেখনী ও তুলিকে নিয়োজিত করেছিলেন আন্তরিকভাবে । দেশপ্রেম ও সদবৃত্তির আদর্শ তুলে ধরাকে শিল্পীর কর্তব্য বলে মেনে নেওয়া হয়েছিল । 

ইউরোপে বিপ্লবের প্রভাব 

ফ্রান্সের মত বিপ্লব ইউরোপের অন্যান্য দেশেও গভীর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল । আধুনিক ভাবধারার ‘ তরবারী ‘ নেপোলিয়ন তাঁর সাম্রাজ্যবাদের মাধ্যমে বিপ্লবকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন অন্যান্য দেশে । ফরাসি পুরাতনতন্ত্রের অবসানের সাথে সাথে ইউরোপীয় পুরাতনতন্ত্রের ভিত্তি শিথিল হতে শুরু করে । শ্রেণীগত বিশেষ অধিকার , অসাম্য প্রভৃতির পরিবর্তে শ্রেণীভেদের অবসান , সামাজিক ও আর্থিক সাম্য , আইনের চক্ষে সমানাধিকার প্রভৃতির দাবিতে জনসমাজ সোচ্চার হতে শিক্ষা পায় এই বিপ্লব থেকেই । 

গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের বিস্তার 

ফরাসি বিপ্লবের বিশেষ তাৎপর্য হল গণতন্ত্রবাদ ও জাতীয়তাবাদের বিস্তার । অতঃপর সারা বিশ্বেই স্বৈরাচার নিন্দিত হয় । রাজার দৈবসত্ত্বের অসারতা ও যুক্তিহীনতা সব মানুষকেই স্পর্শ করে । গণ সার্বভৌমত্বের আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য ইউরোপের নানা দেশে উন্মাদনা সৃষ্টি হয় । একই সঙ্গে জাতীয়তাবাদীদের ধারণা ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট করে বিভিন্ন জাতিকে । 

ইউরোপের যে সমস্ত জাতি অন্যান্য জাতি কর্তৃক পদানত ছিল , তারা জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে থাকে । গ্রীস , বেলজিয়াম , ইতালী , জার্মানী ও বিভিন্ন বল্‌কান রাজ্যগুলি আন্দোলনের ঢেউ তুলে ছিনিয়ে নেয় তাদের জাতীয় রাষ্ট্রের অধিকার । 

সাম্য , মৈত্রী ও স্বাধীনতা — বিপ্লবের এই তিনটি মূল আদর্শ বঞ্চিত , অবহেলিত ও শোষিত মানব জাতির সামনে যে আলোকবর্তিকা তুলে ধরেছিল , তার গুরুত্ব কেবলই অনুধাবনের বিষয় । ` প্রজাহিতৈষী স্বৈরাচার ‘ রাজতন্ত্রের আপাত মধুর শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তে জনগণ ‘ সাধারণের সার্বভৌমত্ব ’ ও ‘ প্রজাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার মহত্তর ও কার্যকরী রূপকে অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছিল ।

আরো পড়ুন : ফরাসি বিপ্লবে বুরবোঁ রাজতন্ত্রের দায়িত্ব

1917 সালের রুশ বিপ্লবের কারণ

error: Content is protected !!