বৌদ্ধ ধর্মের উত্থানের কারণ

Contents

বৌদ্ধ ধর্মের উত্থানের কারণ

খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারতে যে নতুন ধর্মীয় চেতনা ও দার্শনিক চিন্তা ভাবনার উদ্ভব ঘটেছিল , তার মূলে ছিল পারিপার্শ্বিক নানা জিনিসের প্রভাব । সমসাময়িক কালে ভারতের অর্থনৈতিক , সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে বহু পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল । এইসব ক্ষেত্রে পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছিল ধর্মের ক্ষেত্রে এবং তা অনিবার্যভাবে ধর্ম ভাবনার ক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তন সূচিত করেছিল । 

দার্শনিক কারণ 

বৈদিক যুগের শেষ দিকে চিন্তা ভাবনার ক্ষেত্রে নতুন জোয়ার বইতে শুরু করেছিল । উপনিষদে কর্মফল ও জন্মান্তরবাদের তত্ত্ব প্রচারিত হলে তা বহু মানুষকে আকৃষ্ট করে । আড়ম্বর সর্বস্ব ও ব্যয় বহুল যাগযজ্ঞাদি অর্থহীন , মানুষ কর্মানুযায়ী ফল ভোগ করতে বাধ্য —উপনিষদের এই বাণী , এবং কর্মফলের হাত থেকে মুক্তি লাভের জন্য সৎ জীবন যাপন একান্ত পালনীয় — এই বিধান বহু মানুষের মনে নতুন চিন্তার খোরাক যোগায় । উপনিষদের যুগের এই চিন্তাধারাই প্রচলিত বৈদিক ধর্মের পরিবর্তে নতুন ধর্মের উদ্ভবে সাহায্য করে ।  

সামাজিক কারণ 

বৈদিক যুগের শেষ দিকে সামাজিক শ্রেণীভেদ কঠোর ও দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল । সমাজে চারটি রোগীর মধ্যে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় — এই দুই শ্রেণী ছিল উচ্চবর্ণের এবং তাদের বিশেষ মর্যাদা ছিল । এই দুই শ্রেণীর মধ্যে আবার ব্রাহ্মণদের স্থান ছিল ক্ষত্রিয়দের উপর । প্রচলিত ব্রাহ্মণ‍্য ধরনের ঘটিল ক্রিয়াকাণ্ডের ফলে ব্রাহ্মণদের প্রভাব প্রতিপত্তি অনেক বেড়ে গিয়েছিল । পূজার্চনা থেকে এসব আয়ও ছিল যথেষ্ট । ক্ষত্রিয়রা জীবনপণ করে যুদ্ধ করলেও ব্রাহ্মণদের সমান মর্যাদা পেত না । তাই ব্রাহ্মণদের প্রাধান্য নাশ করতে ক্ষত্রিয়গণও আগ্রহী ছিল । 

বৈশ্য ও শুদ্র — এই দুটি শ্রেণি ছিল অবহেলিত ও শোষিত । রাজ্যের অধিকাংশ করভার ওদেরই বহন করতে হত । অবশ্য বৈদিক সমাজে বৈশ্য বা শূদ্রের মতপ্রকাশের কোন সুযোগই ছিল না । তবে একথা অনেকে বিশ্বাস করেন যে , ব্রাহ্মণদের কর্তৃত্ব থেকে ধর্মকে মুক্ত করার আন্দোলনে ক্ষত্রিয়দের বিরাট ভূমিকা ছিল । 

আরো পড়ুন : গৌতম বুদ্ধের জীবনী ও বাণী

অর্থনৈতিক কারণ 

খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারতের অর্থনৈতিক চিত্রের অনেক পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল । এই অর্থনৈতিক রূপান্তর ধর্ম বিপ্লবের পথ প্রশস্ত করেছিল । রোমিলা থাপারের  মতে , সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের পরিবর্তনগুলি , যেমন ― নগর সভ্যতার বিকাশ , কারিগর শ্রেণীর উদ্ভব ও ব্যবসা বাণিজ্যের দ্রুত প্রসার , ধর্মীয় ও দার্শনিক চিন্তার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল ।  

( ১ ) খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে আর্য সমাজে এক আত্মনির্ভরশীল কৃষক শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে । কৃষি ক্ষেত্রে এই অভূতপূর্ব পরিবর্তনের মূলে ছিল লৌহজাত বিভিন্ন কৃষি সরঞ্জামের উদ্ভাবন । লৌহ  নির্মিত লাঙ্গল , মই প্রভৃতির প্রচলনের ফলে চাষ আবাদের আয়তন ও উৎপাদন দ্রুত হারে বৃদ্ধি পায় এবং কৃষকদের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধি পায় । আত্মসচেতন কৃষক সমাজ রক্ষণশীল সমাজের বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে । 

( ২ ) ব্যবসা বাণিজ্যের বিস্তার এই প্রবণতাকে আরও ব্যাপকতা দান করে । নদীর তীরবর্তী অঞ্চলগুলোতে নতুন নতুন নগর গড়ে ওঠার ফলে ঐ সময়ে ব্যবসা বাণিজ্যে উন্নতি হয়েছিল । উত্তর ভারতের সাথে দক্ষিণ ভারতের নদী পথ আবিষ্কৃত হলে বাণিজ্যের পরিধিও অনেক বেড়ে গিয়েছিল । ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারের ফলে বৈশ্য শ্রেণীর আর্থিক সচ্ছলতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল । কিন্তু তখনও এদের সামাজিক সম্মান ছিল না । তাই বৈশ্যরা ব্রাহ্মণত্ববাদের অবসানে নতুন ধর্মমতকে সাদরে গ্রহণ করেছিল । 

( ৩ ) এছাড়া বৈদিক ধর্মে সমুদ্র যাত্রা নিষিদ্ধ ছিল । কিন্তু সমুদ্রপথ বৈশ্যদের জীবিকার অঙ্গ ছিল । এটাও এই শ্রেণীর বিদ্রোহের অন্যতম কারণ ছিল । 

( ৪ ) এই বণিক বা শ্রেষ্ঠী শ্রেণীর আর একটা লাভজনক ব্যবসা ছিল , – সুদের ( interest ) পরিবর্তে ঋণদান করা । কিন্তু বৈদিক সমাজে সুদ গ্রহীতাদের নিচু চোখে দেখা হত । ফলে এই শ্রেষ্ঠীরা ব্রাহ্মণ্য ধর্মকে ধ্বংস করতে আগ্রহী হয়েছিল । 

( ৫ ) তা ছাড়া বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের অহিংসা ও যুদ্ধ বিগ্রহের অপ্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত এবং শান্তির প্রতি আগ্রহ ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারে সহায়ক হয়েছিল বলেও বৈশ্যরা এইসব নতুন ধর্মমতের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল । 

( ৬ ) ষষ্ঠ শতকের কৃষি বিকাশের আর একটি অপরিহার্য শর্ত ছিল গো সম্পদ । মাটিতে লাঙ্গল দেওয়া বা মই টানার কাজে বলদের প্রয়োজন ছিল । চাষ আবাদ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বলদের প্রয়োজনও বেড়েছিল । কিন্তু বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ডের অন্যতম প্রধান অঙ্গ ছিল গো হত্যা । এক একটি বড় যজ্ঞে শতাধিক বলদ বলি দেওয়া হত । এর ফলে গো সম্পদ হ্রাস পেতে থাকে । তাই কৃষকেরা এই ক্ষতিকারক ধর্ম ব্যবস্থা পরিবর্তনে উন্মুখ হয়ে উঠেছিল । 

ধর্মীয় অসন্তোষ 

অনুষ্ঠান সর্বস্ব , ব্যয়বহুল ও অর্থহীন বৈদিক ধর্মাচরণ পদ্ধতি সাধারণ মানুষের অসন্তোষের সৃষ্টি করেছিল । এইসব যাগযজ্ঞে প্রচুর অর্থব্যয় করতে হত । সাধারণ মানুষ ব্রাহ্মণদের নির্দেশে এই অর্থব্যয় করতে বাধ্য হত । পরিণামে তাদের দারিদ্র্য বৃদ্ধি পেত । কিন্তু বৌদ্ধ বা জৈন ধর্মমত ছিল সহজ , সরল ও ব্যবহারিক । তাই বীতশ্রদ্ধ সাধারণ মানুষ খুব সহজে ঐসব ধর্মমতে আকৃষ্ট হয়েছিল । 

উদার ধর্মমতের প্রভাব 

এই সময় পূর্ব ভারতে প্রায় ৬২ টি উদার ধর্মমতের উত্থান ঘটেছিল । এদের অন্যতম ছিল আজীবিক ধর্মমত । এই সকল ধর্ম দর্শন বিপুল জনপ্রিয়তা পায়নি ।

কিন্তু প্রায় প্রতিটি মতবাদেই বৈদিক ধর্মের কঠোরতা , বাহুল্য ও সামাজিক ভেদাভেদ বর্জনের কথা বলা হয়েছিল । প্রত্যেকেই অহিংসার বাণী প্রচার করে । এই সকল ধর্মতত্ত্ব বৌদ্ধধর্মের উত্থানের পটভূমি তৈরী করেছিল । 

এইভাবে দেখা যায় যে , খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে পূর্ব ভারতে বস্তুগত ও চেতনাগত এমন কিছু পরিবর্তন ঘটেছিল যা , বৈদিক ধর্মমত ও আচার আচরণের ভিত শিথিল করেছিল । সামাজিক বৈষম্যজনিত ক্ষোভও এই বস্তুগত পরিবর্তনের সাথে যুক্ত হয় । এইভাবে গতিহীন ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে গণমানসিকতা তৈরী হলে ; বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের উদার তত্ত্ব সহজেই দৃঢ় ভিত্তি খুঁজে পায় ।

আরো পড়ুন : বৌদ্ধ ধর্মের পতনের কারণ

চারটি বৌদ্ধ সংগীতি আলোচনা করো

হীনযান ও মহাযান এর পার্থক্য

প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলনের কারণ

error: Content is protected !!