প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলনের কারণ

Contents

প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলনের কারণ

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারতে বৈদিক ধর্মের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয় তা প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলন নামে পরিচিত । এই আন্দোলনের পিছনে নিম্নলিখিত কারণগুলি কাজ করেছিল ।

প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলনের ধর্মীয় কারণ 

আধ্যাত্মিক অনুসন্ধিৎসা :

বৈদিক যুগের শেষ দিকে মানুষের মনে আধ্যাত্মিক অনুসন্ধিৎসা বৃদ্ধি পায় । ‘ শ্রমণ ’ ও ‘ পরিব্রাজক ‘ নামে দুটি সন্ন্যাসী গোষ্ঠী ছিলেন নতুন চিন্তাধারার অগ্রদূত । তাঁদের প্রভাবে মানুষ কুসংস্কারপূর্ণ ধর্মের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে । 

যাগযজ্ঞে জটিলতা বৃদ্ধি :

বৈদিক যুগের শেষ দিকে বৈদিক ধর্ম ব্রাহ্মণ্য ধর্মে পরিণত হয় । এই ধর্ম যাগযজ্ঞ ও আচার সর্বস্ব হয়ে পড়ায় ধর্মীয় জীবনে প্রচণ্ড অস্থিরতার সৃষ্টি হয় । ব্যয়বহুল যাগযজ্ঞ পূর্ণ ব্রাহ্মণ্য ধর্মাচরণের পদ্ধতি সাধারণ মানুষের কাছে দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে । সাধারণ মানুষের পক্ষে যাগযজ্ঞের বিপুল ব্যয়ভার বহন করা অসম্ভব হয় । যাগযজ্ঞে পশুবলি মানুষের মনে বেদনার উদ্রেক করে । ক্রমে মানুষ বুঝতে পারে , যাগযজ্ঞ কর্মফল ও জন্মান্তর থেকে মানুষকে কখনোই মুক্ত করতে পারে না । তাই ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রতি মানুষের আস্থা হ্রাস পায় । মানুষ সহজবোধ্য ও অনাড়ম্বর ধর্মের জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে । 

ধর্মাচরণের অধিকার হ্রাস : 

ব্রাহ্মণ্য ধর্মে বৈশ্য ও শূদ্র শ্রেণির ধর্মাচরণের অধিকার বিশেষভাবে হ্রাস পায় । অথচ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সমস্ত ব্যয়ভার তাদেরই বহন করতে হত । নারীরাও বেদ পাঠের অধিকার হারিয়ে ক্ষুব্ধ হয় । এইসব কারণে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধে তেষট্টিটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর উদ্ভব হয় । এর মধ্যে জৈন ও বৌদ্ধ ধর্ম সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল ।

আরো পড়ুন : বৌদ্ধ ধর্ম ও জৈন ধর্মের মধ্যে পার্থক্য

মহাবীরের জীবনী ও তাঁর শিক্ষা

প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলনের অর্থনৈতিক কারণ 

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারতের অর্থনৈতিক চিত্রে অনেক পরিবর্তন ঘটেছিল । এই অর্থনৈতিক রূপান্তর প্রতিবাদী আন্দোলনের সহায়ক ছিল । ড. রোমিলা থাপার  লিখেছেন — সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের পরিবর্তন সমূহ , যেমন — নগর সভ্যতার বিকাশ , কারিগর শ্রেণির উদ্ভব ও ব্যাবসা বাণিজ্যের দ্রুত প্রসার , ধর্মীয় ও দার্শনিক পরিবর্তনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল । 

কৃষকদের অবস্থার পরিবর্তন : 

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ব্রাহ্মণ্য সমাজে এক আত্মনির্ভরশীল কৃষক শ্রেণির উদ্ভব হয় । এর মূলে ছিল লৌহ নির্মিত কৃষি সরঞ্জামের ব্যবহার ও গো-সম্পদ । লোহার তৈরি লাঙল ও মই ইত্যাদি ব্যবহারের ফলে কৃষি উৎপাদন অভূতপূর্ব ভাবে বৃদ্ধি পায় । কিন্তু বৈদিক যাগযজ্ঞে প্রচুর পরিমাণ গো-বলি শুরু হলে নতুন কৃষি অর্থনীতি সমস্যার সম্মুখীন হয় । এই সময় গৌতম বুদ্ধ ও মহাবীর ‘ জীবে দয়া ’ এবং ‘ অহিংসা ’ এর বাণী প্রচার করলে কৃষকশ্রেণি তাঁদের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং ক্ষতিকারক ধর্ম ব্যবস্থার পরিবর্তনে আগ্রহী হয়ে ওঠে । 

ব্যবসায়ী শ্রেণির উচ্চাকাঙ্ক্ষা : 

এই সময় নদী তীরবর্তী অঞ্চলে বহু নতুন নগর প্রতিষ্ঠিত হয় । ফলে ব্যাবসা বাণিজ্য বৃদ্ধি পায় । বাণিজ্য বৃদ্ধির ফলে বৈশ্য শ্রেণির আর্থিক সমৃদ্ধি ঘটে এবং তারা সামাজিক মর্যাদা লাভের জন্য ব্রাক্ষণ্যবাদের অবসান কামনা করে ।

ব্যয়বহুল আচার : 

বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ছিল আড়ম্বর সর্বস্ব এবং ব্যয়বহুল । ধর্মের প্রধান অঙ্গ ছিল যজ্ঞ । যজ্ঞ পরিচালনার জন্য সাধারণ মানুষকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে বাধ্য করা হত । তাই তারা নতুন ধর্মে আকৃষ্ট হয় ।

প্রতিবাদী ধর্মের উত্থানে বৈশ্য শ্রেণির সহযোগিতা

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে নানা কারণে ব্যাবসায়ী শ্রেণির আর্থিক ভিত্তি সুদৃঢ় হয় । কিন্তু ব্রাহ্মণ্য ধর্মের রীতিনীতি তাদের আর্থিক উন্নতির পথে বাধা সৃষ্টি করত । বৌদ্ধ , জৈন ইত্যাদি প্রতিবাদী ধর্মমতের মধ্যে তারা তাদের বৃত্তিগত সুযোগ সুবিধা খুঁজে পায় । যেমন— 

( i ) সেই সময়ে নদী তীরবর্তী অঞ্চলে বহু নতুন নগর প্রতিষ্ঠিত হয় । ফলে ব্যাবসা বাণিজ্য বৃদ্ধি পায় । বৈশ্য শ্রেণির আর্থিক সমৃদ্ধি ঘটে । তারা সামাজিক মর্যাদা লাভের জন্য উদ্গ্রীব হয়ে ওঠে এবং ব্রাহ্মণদের সামাজিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে , প্রতিবাদী ধর্মমতের সমর্থকে পরিণত হয় । 

( ii ) ব্রাহ্মণ্য ধর্মে সমুদ্র যাত্রা নিষিদ্ধ ছিল । কিন্তু সমুদ্রপথে বাণিজ্য করে বৈশ্যদের অর্থাগম হত । তাই তারা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় । 

( iii ) বৈশ্যদের একাংশ সুদের বিনিময়ে অর্থ ঋণ দিত । কিন্তু ব্রাহ্মণ্য সমাজে সুদের কারবারিদের হীন চোখে দেখা হত । ফলে সুদের কারবারি শ্রেষ্ঠীরা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ করে । 

( iv ) নতুন ধর্ম দর্শনে যুদ্ধ বিগ্রহকে পরিহার করার কথা বলা হয় । এই শান্তির নীতি ব্যাবসা বাণিজ্যের সহায়ক ছিল । তাই ব্যবসায়ী শ্রেণি নতুন ধর্মমতের সমর্থকে পরিণত হয় এবং প্রতিবাদী আন্দোলনকে শক্তিশালী করে ।

প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলনের রাজনৈতিক কারণ 

গণরাজ্য প্রতিষ্ঠা : 

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে ভারতীয় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বেশ কিছু গণরাজ্যের প্রতিষ্ঠা , সেই গণরাজ্যগুলিতে মতপ্রকাশের অবাধ স্বাধীনতার সুযোগ এবং উপজাতীয় রীতিনীতির অনুসরণে সেই গণরাজ্যগুলিতে বর্ণাশ্রম বিহীন সমাজের প্রতিষ্ঠা প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলনের রাজনৈতিক পটভূমি তৈরি করেছিল । উল্লেখ্য , সেই সময়ে হিমালয়ের পাদদেশে ও উত্তর পশ্চিম পাঞ্জাবে এরূপ গণরাজ্যগুলি গড়ে উঠেছিল । ড. রোমিলা থাপারের  মতে , সম্ভবত বৈদিক গোঁড়ামির প্রতিক্রিয়ারূপে গণরাজ্যগুলির উদ্ভব হয়েছিল । 

নতুন সমাজ স্থাপন : 

ব্রাহ্মণ্য ধর্মের রক্ষণশীলতার পরিবর্তে নব গঠিত গণরাজ্যগুলিতে উপজাতীয় রীতিনীতি অনুযায়ী বর্ণাশ্রম বিহীন নতুন সমাজ স্থাপিত হয় । সেখানে ব্রাহ্মণদের প্রতি বিশেষ সম্মান প্রদর্শন বা বৈদিক রীতি মান্য করা বাধ্যতামূলক ছিল না । 

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা : 

গণরাজ্যগুলিতে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীন মতপ্রকাশের অবাধ সুযোগ ছিল । এই উদার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মহাবীর বা গৌতম বুদ্ধ তাঁদের দর্শন গড়ে তোলার সুযোগ পেয়েছিলেন এবং তাঁরাই ব্রাহ্মণ্যবাদের অসাম্য ও অবিচারের বিরুদ্ধে সমাজ সংস্কারের ডাক দিয়েছিলেন ।  

প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলনের দার্শনিক কারণ  

পরিব্রাজকদের প্রভাব : 

বৈদিক যুগের শেষদিকে ভারতীয় চিন্তা জগতে এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে । এসময় মানুষের মনে আধ্যাত্মিক অনুসন্ধিৎসা বড়ো হয়ে দেখা দেয় । এই নতুন চিন্তার অগ্রদূত ছিলেন পরিব্রাজক ও শ্রমণ নামক ভবঘুরে সন্ন্যাসী গোষ্ঠী । এঁদের অধিকাংশই ছিলেন অব্রাহ্মন  । প্রকৃতপক্ষে এঁরাই গাঙ্গেয় উপত্যকার মানুষের মনে আধ্যাত্মিক জিজ্ঞাসার জন্ম দেন । যাগযজ্ঞের পরিবর্তে সৎ চিন্তা ও সৎ আচরণ দ্বারা এঁরা ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভের কথা প্রচার করেন । এঁদের এই প্রচার বেদ ভিত্তিক রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ভিত্তিমূলে আঘাত করে । 

উপনিষদের প্রভাব : 

উপনিষদে কর্মফল ও জন্মান্তরবাদের তত্ত্ব প্রচারিত হলে , তা মানুষের মনে নতুন চিন্তার খোরাক জোগায় । উপনিষদে বলা হয় , মানুষ তার কর্ম অনুযায়ী ফল ভোগ করতে বাধ্য । যাগযজ্ঞ বা আড়ম্বরপূর্ণ পূজা অর্চনা দ্বারা মুক্তি সম্ভব নয় । ওল্ডেনবার্গ  লিখেছেন যে , বুদ্ধের আবির্ভাবের শত শত বৎসর পূর্বেই ভারতীয় চিন্তাধারার এমন অগ্রগতি হয়েছিল , যা বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশের পথ প্রশস্ত করেছিল ।

প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলনের সামাজিক কারণ 

বৈদিক ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের একাধিপত্বের বিরুদ্ধে অন্যান্য সম্প্রদায়ের ক্ষোভ : 

বৈদিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত ছিল সামাজিক অসাম্যের ওপর , আর এই অসাম্যের মূলে ছিল বর্ণভেদ প্রথা । বর্ণ বিভক্ত বৈদিক সমাজে ব্রাহ্মণের স্থান ছিল সবার ওপরে — সমাজ ও রাষ্ট্রে তারা বহু সুযোগ সুবিধার একচেটিয়া অধিকারী ছিল । সমাজের অন্যান্য শ্রেণির মধ্যে ব্রাহ্মণদের এই একচেটিয়া আধিপত্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ধূমায়িত হচ্ছিল । 

ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় দ্বন্দ্ব : 

যুদ্ধে অংশ গ্রহণ , রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষা ও প্রশাসন পরিচালনার মতো গুরুদায়িত্ব পালন করা সত্ত্বেও সমাজ ও রাষ্ট্রে ব্রাহ্মণদের তুলনায় ক্ষত্রিয়দের মর্যাদা ও অধিকার ছিল কম— এই পরিস্থিতি রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী ক্ষত্রিয়দের কাছে ক্রমেই অসহনীয় হয়ে দাঁড়ায় এবং এরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলনে , যে আন্দোলনের স্রষ্টাদের মধ্যে বিখ্যাত দুই পুরুষ মহাবীর ও গৌতম বুদ্ধ ছিলেন ক্ষত্রিয় বংশজাত । 

ব্রাহ্মণ শাসিত সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বৈশ্য ও শূদ্রদের ক্ষোভ : 

সম্পদ সৃষ্টি ও রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক দায়দায়িত্ব পালন করা সত্ত্বেও বৈদিক সমাজ ও রাষ্ট্র বৈশ্য ও শূদ্রদের কোনোরকম মর্যাদা দেয়নি । এই শ্রেণি বৈষম্য বঞ্চিত বর্ণ দুটির মধ্যে প্রবল ক্ষোভের সঞ্চার করেছিল । বৌদ্ধ ও জৈন — এই দুই প্রতিবাদী ধর্মের বর্ণভেদহীন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার বৈশ্য ও শূদ্রদের শুধু তাদের দিকে আকৃষ্টই করেনি , ধর্ম দুটির প্রবল সমর্থকেও পরিণত করেছিল । 

ব্রাহ্মণ্য সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নারী জাতির ক্ষোভ : 

ব্রাহ্মণ্য সমাজে নারী জাতিকে সম্মানের চোখে দেখা হত না । নারীদের বেদ পাঠের এবং পারিবারিক সম্পত্তির অধিকার থেকেও বঞ্চিত করা হয় । ব্রাহ্মণ্য সমাজে সমাজচ্যুতা রমণীরা ছিল অবজ্ঞা ও অবহেলার পাত্রী । বুদ্ধ ও মহাবীর নারীজাতি , এমনকি সমাজচ্যুতা রমণীদেরও মর্যাদা দেওয়ায় তারা নতুন ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয় ।

আরো পড়ুন : গৌতম বুদ্ধের ধর্মমত

গৌতম বুদ্ধের জীবনী ও বাণী

error: Content is protected !!