কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা পদ্ধতি
Contents
কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা পদ্ধতি
ফ্রয়েবেলের শিক্ষণ পদ্ধতি ‘ কিন্ডারগার্টেন ‘ পদ্ধতি নামে পৃথিবী বিখ্যাত । ‘ কিন্ডারগার্টেন ‘ কথার অর্থ হল ‘ শিশু উদ্যান ‘ । বিদ্যালয় হল একটি উদ্যান স্বরূপ । শিশুরা হল সেই উদ্যানের চারাগাছ এবং শিক্ষক হলেন তার মালী । শিক্ষার দ্বারা শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশের চেষ্টা করা হয় ।
ফ্রয়েবেলের মতে শিক্ষা বাইরে থেকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যায় না । শিক্ষণ পদ্ধতিতে শারীরিক শাস্তি ও শাসন ইত্যাদির স্থান গৌণ হওয়া উচিত । ফ্রয়েবেলের মতে শিশু তার স্বাভাবিক অনুরাগ ও চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষা লাভ করবে । স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দের মধ্য দিয়ে শিশুকে শিক্ষা দিতে হবে । শিশুর মধ্যে এই স্বতঃস্ফূর্ততা সব সময়ই দেখা যায় ; স্বাভাবিকভাবেই সে সক্রিয় । এই সক্রিয়তাকে তিনি আত্মসক্রিয়তা ( Self – activity ) বলেছেন ।
এই ধরনের সক্রিয়তা শিশুর নিজের প্রেরণার দ্বারা নির্ধারিত হয় , নিজের অনুরাগ দ্বারা জাগ্রত থাকে এবং নিজের মানসিক শক্তি তাকে ক্রিয়াশীল রাখে । তিনি মনে করেন , এই ধরনের আত্মজক্রিয়াশীল সত্তাই মনের অভিব্যক্তি ঘটাতে পারে । [ “ Activity determined by one’s own motives , arising out of one’s own interests , sustained by one’s power – can alone produce this evolution of mind , can secure that which is held to be the aim of education ” – Monroe ]
ফ্রয়েবেল বলেছেন – এই ধরনের সক্রিয়তাকে স্বতঃস্ফূর্ত না বলে বাধ্যতামূলকও বলা যেতে পারে । কারণ , এটি ব্যক্তির আন্তরিক সত্তার নিয়ন্ত্রণেই হয়ে থাকে । কিন্তু তাহলেও তিনি বলেছেন , যেহেতু ব্যক্তি বাইরের কোন সংস্থার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না , তার নিজের অন্তরের তাগিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় , সেদিক থেকে বিবেচনা করে একে আমরা তা স্বতঃস্ফূর্ত ক্রিয়া বলতে পারি । এই আত্মসক্রিয়তাকে তিনি শিক্ষণের মূল পদ্ধতি হিসেবে বিবেচনা করেছেন ।
আদর্শ শিক্ষণ পদ্ধতি হবে সেই পদ্ধতি যাতে শিশুর এই আত্মসক্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে পাঠদানের কাজ পরিচালনা করা হবে । শিশুর প্রথম আত্মসক্রিয়তার প্রকাশ পায় পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজন করতে গিয়ে এবং যে কোন শিক্ষণ পদ্ধতি তাঁর এই স্বতঃস্ফূর্ত আগ্রহ ও ক্রিয়াকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে । এটাই হল তার পদ্ধতির তাত্ত্বিক ভিত্তি ।
খেলাচ্ছলে শিক্ষা
শিশুর এই আত্মসক্রিয়তার প্রকাশ হয় খেলার মাধ্যমে । সেইজন্যই ফ্রয়েবেলই প্রথম শিক্ষাবিদ যিনি খেলার মধ্য দিয়েই শিক্ষাদানের কথা বলেছেন । তাঁর মতে খেলার মধ্য দিয়েই শিশুর জগৎ সংসারের মধ্যে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর প্রয়াসী হয় , তার মধ্যে দিয়েই সে চির শাশ্বত সত্য যে ঈশ্বর তাঁকে উপলব্ধি করতে পারে । ফ্রয়েবেল খেলার এই গুরুত্বের কথা শুধু মুখেই বলেননি , প্রত্যক্ষভাবে তাঁর কিন্ডারগার্টেন এ প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন ।
প্রাকৃতিক পরিবেশে শিক্ষা
রুশোর মত ফ্রয়েবেলও তার কিন্ডারগার্টেন পদ্ধতিতে প্রকৃতির ( Nature ) সাহায্যে শিক্ষা দেওয়ার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন । কেবলমাত্র বই মুখস্থ করে শিক্ষাদানের পদ্ধতিকে তিনি স্বীকার করেননি । তিনি বলেছেন— ‘ Nature reveals god to the child ‘ তিনি রুশোর মত শিশুকে সামাজিক পরিবেশ থেকে সরিয়ে এনে প্রকৃতির কোলে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন ।
বস্তু ভিত্তিক শিক্ষা , উপহার ও বৃত্তি
ফ্রয়েবেল তার কিন্ডারগার্টেন পদ্ধতিতে পেস্তালাৎসির মত বস্তু ভিত্তিক শিক্ষা পদ্ধতি এবং হাতের কাজের মাধ্যমে শিক্ষাদান পদ্ধতির প্রবর্তন করেন । বস্তুগুলির তিনি নাম দিয়েছেন উপহার ( Gift ) এবং কাজগুলির নাম দিয়েছেন বৃত্তি ( Occupation ) । এইসব বস্তু মাধ্যমে ফ্রয়েবেল জগতের নিয়মাবলীকে সাংকেতিক ভাবে শিশুর কাছে পরিবেশন করতে চেয়েছেন । এই বস্তুগুলির মাধ্যমে শিশুরা বস্তু জগৎ সম্পর্কে ধারণা পায় । এগুলি তার অর্ন্তদর্শনে সাহায্য করে । এদের মধ্যে দিয়ে শিশুর ঘনবস্তু সম্পর্কে ধারণা জন্মে , এর থেকে গণিতের ধারণা জন্মে এবং বিশ্বপ্রকৃতির সামঞ্জস্যের সৌন্দর্য ( Beauty of symmetry ) সম্বন্ধে সে অবগত হয় ।
বৃত্তি বলতে তিনি বিভিন্ন ধরনের হাতের কাজকে নির্বাচন করেছেন । কাগজের সাহায্যে বিভিন্ন ধরনের জিনিস নির্মাণ করা , কাঠের কাজ , তাঁর বোনা , ছবি আঁকা ইত্যাদিকে বৃত্তি হিসাবে নির্বাচন করেছেন । এই ধরনের কাজের মাধ্যমে শিশু নিজের সত্তাকে প্রকাশ করার সুযোগ পায় ।
ছড়া ও গানের মাধ্যমে শিক্ষা
ছড়া ও গানের মাধ্যমে শিক্ষাদান ফ্রয়েবেলের শিক্ষা পদ্ধতির আর একটি বৈশিষ্ট্য । শিশুমাত্রই ছন্দ এবং সুর ভালবাসে । গানকে তিনি দু’ভাগে ভাগ করেছেন — মায়ের গান এবং খেলার গান । তিনি সাতটি মায়ের গান এবং পঞ্চাশটি খেলার গানের মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়ার কথা বলেছেন । গানের উপযোগিতার দিক থেকে তাদের তিন চারটে শ্রেণীতে ভাগ করেছেন—
( ১ ) ছোট শিশুদের জন্য রূপকথার গান , এর দ্বারা শিশুর কল্পনা শক্তিকে জাগ্রত করা হয় ;
( ২ ) অপেক্ষাকৃত বড়দের জন্য বিভিন্ন বস্তুর সঙ্গে পরিচিতির জন্য গান ;
( ৩ ) চন্দ্র , সূর্য , তারা এবং নৈসর্গিক ঘটনার বিবরণ সংবলিত গান এবং
( ৪ ) নৈতিক চরিত্র গঠনের উপযোগী উপদেশমূলক গান । এইসব গান গাইবার সময় উপযুক্ত অঙ্গ সঞ্চালন করা হয় এবং ছন্দোময় নাচেরও ব্যবস্থা থাকে ।
ফ্রয়েবেলের শিক্ষণ পদ্ধতির মূল কথা হল — শিশুর স্বতঃস্ফূর্ত সক্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষা ক্ষেত্রকে আনন্দময় করে তোলা । শিশুর স্বাভাবিক প্রবণতা থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে বিশ্বপ্রকৃতির রহস্য উপলব্ধি করতে সহায়তা করা । এ সম্পর্কে ইতিপূর্বে ‘ আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতি ’ শীর্ষক অধ্যায়ে আমরা বিশদভাবে আলোচনা করেছি । এই শিক্ষণ পদ্ধতি সম্পর্কে রাস্ক ( Rusk ) বলেছেন— “ By his methodological arrangement of the gifts and occupations , Froebel nevertheless founded a new type of educational institution and although his system lent itself to formalism by later generations of the teachers , who had not the sprit of master , it ameliorated the lots of countless children . “
আরো পড়ুন : কিন্ডারগার্টেন পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য
কিন্ডারগার্টেন পদ্ধতির পাঠ্যক্রম